রাজাকারের সন্তানদের আস্ফালনে ঘৃণা-ক্ষোভ আইজিপির, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে সুসংহত করার আহ্বান
প্রকাশিতঃ 12:18 am | July 29, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
ইতিহাসের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্র কঠিন আহ্বানে পাকিদের প্রথম প্রতিরোধে ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়েছিল তাঁর পূর্বসূরীরা। শত্রু সেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে করেছিল লড়াই-সংগ্রাম। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ তীব্র স্লোগান তুলে ট্যাঙ্কের সামনে পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল হাকিমসহ অগণিত পুলিশ সদস্যরাও এগিয়ে দিয়েছিল নিজেদের সাহসী বুক।
স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে বীরের জাতি বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করা দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীর গর্বিত সদস্যদের চেতনার বহ্নিশিখা প্রতিক্ষণ আলোড়িত-আন্দোলিত করে তাঁর হৃদয়ের জমিনকে। তাঁর কাছে ৭১ মানেই কভু মাথা নত না করা!
স্বভাবতই পাকিস্তানী হিংস্র শ্বাপদের গণহত্যার দোসর রাজাকারের সন্তানদের ভয়াবহ আস্ফালন ব্যথাভারাতুর করে মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনায় সমৃদ্ধ পুলিশপ্রধান ড.বেনজীর আহমেদের মন-মননকে। ফলশ্রুতিতে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও অহঙ্কারে উজ্জীবিত হয়ে রাজাকারের সন্তানদের দম্ভ চূর্ণ করতে তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার (২৮ জুলাই) পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ভার্চুয়ালি নোয়াখালী জেলা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আলোকময় চেতনার ক্যানভাসে নিজেকে রাঙিয়ে রাজাকারের সন্তানদের ঘৃণ্য ধূর্ততা ভরপুর বাগাড়ম্বরকে ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করে নিজ বাহিনীর সদস্যদের মাঝে স্বাধীনতার চিরভাস্বর সূর্যকে আরও একবার দেদীপ্যমান করেছেন নিজের কন্ঠে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাকিদের হটাতে পুলিশ বাহিনীতে নিজের পূর্বসূরী বীর শহীদদের অর্জন-ইতিহাসের সারকথা।
নোয়াখালী জেলা পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘নির্ভীক’, নবনির্মিত সুধারাম মডেল থানা, সোনাপুর পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশ লাইন্স নারী ব্যারাক ভবন উদ্বোধন এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ নোয়াখালী জেলা’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধ ও নির্ভীকচিত্তেই নিজেকে তুলে আনেন ড.বেনজীর।

হিমাদ্রি শেখর সফলতার মূর্ত-স্মারক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক অভিযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলার সময়টিতেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে পরিপূর্ণতা দিতে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে দেশকে এগিয়ে নেওয়ারও আহ্বান জানান। প্রাণিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধেও।
বাংলাদেশকে নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করা উদ্ধৃতি তুলে ধরে আইজিপি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য এসেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন আমরা সেটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আগামী বছরের পর বছর বাংলাদেশ টিকে থাকবে। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আত্নমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বসবাস করবে।’
রাজাকারের সন্তানের আস্ফালনে ঘৃণা-ক্ষোভ আইজিপির
সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজাকারের সন্তানদের আস্ফালন ও স্পর্ধায় নিজের সুর চড়া করে ড.বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আমরা হতভম্ব হয়ে দেখি রাজাকার পুত্ররা দম্ভের সাথে চিৎকার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলছে, আমি রাজাকার পুত্র’। স্বাধীনতার মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এ রাজাকারের পুত্র-সন্তানরা কিভাবে এ দু:সাহস পায় বাংলার মাটিতে, যারা দু’লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হরণ করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে তাদের পক্ষ নিয়ে দম্ভ করার?’

রাজাকারের সন্তানদের দম্ভ চূর্ণ করতে দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের জাগ্রত হতে আহ্বান জানিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দোসররা মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আস্ফালন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোটি কোটি মানুষের সামনে বলে তারা রাজাকার পুত্র। এ দম্ভ চূর্ণ করতে হবে এ দেশের সাধারণ মানুষকে।’
একটি ঐতিহাসিক দায় ও কর্তব্য
আইজিপি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে আমাদের পূর্বসূরীরা যে দেশটিকে আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন, তাদের যে অনবদ্য আত্মত্যাগ, সে আত্মত্যাগের মর্যাদা ধরে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা। এটি একটি ঐতিহাসিক দায়, একটি ঐতিহাসিক কর্তব্য।
দেশ ও মানুষের জন্য, স্বাধীনতার জন্য স্ত্রী ও সন্তানসহ স্বপরিবারে নোয়াখালী জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার আবদুল হাকিমের মহান আত্মত্যাগের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন ড.আহমেদ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী নোয়াখালী জেলা পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা ও বীর পুলিশ সদস্যদের অবদানকেও সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন তিনি।

ইতিহাস সংরক্ষণের তাগিদ
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সর্বপ্রথম দেশের পক্ষে লড়াই করেছে উল্লেখ করে পুলিশপ্রধান আরও বলেন, ‘মুক্তিযুেেদ্ধ প্রথম বুলেটটি নিক্ষিপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের রাইফেল থেকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম শাহাদাতবরণকারীও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য এরকম ঝুঁকি নিয়েছেন আমি মনে করি আগামী প্রজন্মের এই বিষয়গুলো জানা দরকার।’
আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ইতিহাস সংরক্ষণের তাগিদ দিয়ে আইজিপি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ যে জায়গায় পৌঁছেছে এজন্য বারবার আমাদের ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে। পুলিশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরতে নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অনেক বই পুস্তক লিখতে হবে। পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি যারা যেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে যে বীরত্বগাঁথাগুলো রয়েছে সেই বীরত্বগাঁথাগুলোও আমাদের ডকুমেন্টেড করা উচিত।’
আরও সুসংহত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব-অহঙ্কারকে
পুলিশপ্রধান বলেন, ‘১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষ যে দুর্নিবার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছিল আমাদেরকে সেই অহংকারের জায়গাগুলোকে আরও সুসংহত করতে হবে। এক্ষেত্রে এ ধরনের পুস্তক, ভাস্কর্য হতে পারে অন্যতম নিয়ামক, যাতে আমরা কখনো ইতিহাস বিস্মৃত না হই।’

একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে এগুলোকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ডকুমেন্টেড করতে হবে, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর মর্যাদা অনুভব করতে পারে, অহংকার করতে পারে, একটা মর্যাদাবান জাতি হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে সবাইকে সচেষ্ট হওয়ারও আহবান জানান আইজিপি।
অনুষ্ঠানের অংশ বিশেষ
নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলমগীর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’র সভাপতি হাবিবুর রহমান, নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবাল হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বক্তারা নোয়াখালী জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) শহীদ আব্দুল হাকিমের মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান।

অনুষ্ঠানে পুলিশ সদর দপ্তর প্রান্তে অতিরিক্ত আইজি ড. মোঃ মইনুর রহমান চৌধুরী, অতিরিক্ত আইজি এস এম রুহুল আমিন, অতিরিক্ত আইজি মো. মাজহারুল ইসলাম, এটিইউ’র অতিরিক্ত আইজি মো. কামরুল আহসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে আইজিপি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভাস্কর্য ‘নির্ভীক’, নোয়াখালী জেলা পুলিশের নবনির্মিত সুধারাম মডেল থানা, সোনাপুর পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশ লাইন্স নারী ব্যারাক ভবন ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন। তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ- নোয়াখালী জেলা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন। বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রকাশিত বইটি সম্পাদনা করেছেন মো. আলমগীর হোসেন। গবেষণায় ছিলেন, এ কে এম গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ, আবু নাছের মঞ্জু ও মোঃ এনায়েত করিম।
কালের আলো/এমএএএমকে