শতকোটি টাকা পাচ্ছে মুন সিনেমার মালিকপক্ষ

প্রকাশিতঃ 2:41 pm | October 08, 2018

কালের আলো ডেস্ক:

পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিক ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডকে ১০০ কোটি দিতে যাচ্ছে সরকার। এ মূল্য পরিশোধের জন্য সরকারকে দুই মাস সময় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ সোমবার এই আদেশ দেয়।

পুরান ঢাকার যে মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে মামলার পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় এসেছিল, সেই জমি এবং তার ওপর গড়ে তোলা বর্তমান স্থাপনার মূল্য বাবদ ৯৯ কোটি ২১ লাখ টাকা মালিক পক্ষকে দেয়ার প্রস্তার রয়েছে বলে আদালতকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এদিন আদালতকে জানান, মুন সিনেমা হলের মালিক ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডকে ওই অর্থ দিতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মত হয়েছে।

অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল তিন মাস সময় চাইলে আদালত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক। মুন সিনেমা হলের মালিকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি ও সাইফুল্লাহ মামুন।

অ্যাটর্নি জেনারেল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির চিঠি আদালতে উপস্থাপন করার পর প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলা শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। আর কত দিন এভাবে ঘুরাবেন।

মাহবুবে আলম বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা পেলেই তা ইটালিয়ান মার্বেলকে দিয়ে দেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। আগামী ৯ ডিসেম্বর মামলাটি আবারও আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসবে বলে একরামুল হক টুটুল জানিয়েছেন।

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে এক সময়ের মুন সিনেমা হলের মূল মালিক ছিল ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই সম্পত্তি ‘পরিত্যক্ত’ ঘোষণা করা হয় এবং পরে শিল্প মন্ত্রণালয় ওই সম্পত্তি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত করে। ইতালিয়ান মার্বেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুল আলম ওই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করলেও বিষয়টি আটকে যায়।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি সামরিক ফরমান ঘোষণা করেন, যাতে বলা হয়, সরকার কোনো সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলে আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। মুন সিনেমা হলের সম্পত্তিও এর আওতায় পড়ে যায়।

ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস এরপর ২০০০ সালে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে, যেখানে সংবিধানের ওই পঞ্চম সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০০৫ সালের ২৯ অগাস্ট হাই কোর্ট যে ঐতিহাসিক রায় দেয়, তাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ সংবিধান-বহির্ভূত ও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের রায় বহাল রাখে এবং ৯০ দিনের মধ্যে মুন সিনেমা হল ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেডকে ফেরত দিতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়।

এরপর দীর্ঘ দিনেও মালিকানা ফিরে না পেয়ে ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি ইতালিয়ান মার্বেল কর্তৃপক্ষ তখনকার ভূমিসচিব, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করে।

সেই অভিযোগের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ১৯৭২ সালে মুন সিনেমা হল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০১ সালে প্রতীকী মূল্য ১ টাকা দরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তা হস্তান্তর করে ডেভেলপারদের কাছে। ডেভেলপাররা মূল সিনেমা হলটি ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করে এবং নিজেদের অংশ বর্তমান দোকান মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

এ অবস্থায় মুন সিনেমা হল আগের অবস্থায় ফেরত দেওয়ার কোনো উপায় নেই জানিয়ে জমির মূল্য ও মুন সিনেমা হলের মূল কাঠামোর মূল্য ধরে এর মালিককে দেওয়া যেতে পারে বলে আদালতে মত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

ওই শুনানির পর আপিল বিভাগ সিনেমা হলের জমি, স্থাপনার মূল্য নির্ধারণের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেয়। তিনি মুন সিনেমা হল ও এর জায়গার মূল্য ৯৯ কোটি ২১ লাখ টাকা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেন।

ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি মুন সিনেমা হলের মালিককে ওই অর্থ তিন কিস্তিতে পরিশোধের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে নির্দেশ দেয় আদালত।

আদেশে বলা হয়, প্রথম কিস্তিতে দুই মাসের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা, পরের দুই মাসের মধ্যে আরও ২৫ কোটি এবং বাকি টাকা আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বলে আসছিল, এত টাকা দিতে তারা অপারগ। সরকারকেই এ দায় শোধ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে তারা অর্থ পরিশোধ না করায় গত ১ জুলাই আপিল বিভাগ দ্রুত অর্থ পরিশোধের জন্য মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষকে মৌখিক নির্দেশ দেয়। আদালত বলে, অর্থ পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তলব করা হবে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল টুটুল সোমবার বলেন, ওই অর্থ পরিশোধ করবে মামলার বিবাদী, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্তু টাকা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। আজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত এক চিঠি মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে উপস্থাপন করেছেন। এতে জানানো হয়েছে, সংশোধিত বাজেট থেকে ওই অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, মুন সিনেমা হল ও এর সম্পত্তির মূল্য বাবদ ৯৯ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৪ টাকা ২৭ পয়সা পরিশোধের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা নেয়া হবে।