‘নৌ পরিবহন খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব’
প্রকাশিতঃ 9:15 pm | October 09, 2018
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নৌ পরিবহন খাতে দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এ খাতকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখা সম্ভব।’
মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডস্থ লা মেরিডিয়ান হোটেলে দ্বিতীয় সাউথ এশিয়া মেরিটাইম অ্যান্ড লজিস্টিক ফোরাম ২০১৮-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শুধু আমাদের নিজের দেশ নিয়ে ভাবি না, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশগুলো তাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলের সকল মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, নদী ও নৌযান উন্নয়নে এবং মানুষ ও পণ্য পরিবহনে নদীর নাব্যতা রক্ষা, নদীর মাধ্যমে জলাধার সৃষ্টি ও নিরাপদ নদীপথ উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নাব্যতা রক্ষার জন্য নদীগুলোতে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নৌপরিবহন ব্যবস্থা মূল্য ও জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে যৌক্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবহন মাধ্যম হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এজন্য আমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌ রুটগুলো চালুর উদ্যোগ নিয়েছি।
সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) সনদ স্বাক্ষরকারী দেশ। ‘আইএমও ২০২০’ এর অর্থ হচ্ছে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাসের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সামুদ্রিক জাহাজগুলোতে বিদ্যমান ৩.৫ শতাংশ সালফারযুক্ত জ্বালানির পরিবর্তে ০.৫ শতাংশ সালফারযুক্ত জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে শুরু করেছি এবং নৌপরিবহন ব্যবস্থাতেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, তার সরকার বাংলাদেশের জন্য একটি আধুনিক, দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে সীমিত কার্বন নির্গমন কৌশলই হবে আমাদের মৌলিক বিবেচ্য বিষয়।
শিপিং খাতে নতুন নতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কনফারেন্স ইভেন্টস এবং ভারতের গেটওয়ে মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড যৌথভাবে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। ভারতের সড়ক ও নৌ পরিহনমন্ত্রী মানসুখ মান্দাভিয়া, শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. হর্ষ ডি সিলভা, ইন্ডিয়া গেটওয়ে মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের এডিটর ইন চিফ রাম প্রসাদ রবি এবং বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুস সামাদ প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশের নৌ পরিবহন খাত নিয়ে অনুষ্ঠানে একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও উপস্থাপন করা হয়।
ড্রেজিং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কের পরিবর্তে নৌপথে কার্গো পরিবহনে প্রতিবছর ব্যয় সাশ্রয় হয় প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে নদীর নাব্যতা রক্ষা ও নিরাপদ নদীপথ উন্নয়নে প্রতিবছর ড্রেজিং বাবদ ব্যয় হয় ৬০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, আমাদের ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট পলিসিতেও অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
সুদূর প্রাচীনকালে এদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ইদানিং জাহাজশিল্প নতুন রূপে আশার আলো দেখাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে নির্মিত পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ এখন ডেনমার্ক, জার্মানি পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য ও বাজার সম্প্রসারণের ফলে সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এ অঞ্চলের পণ্য সরবরাহ ও সামুদ্রিক পরিসেবা প্রসারিত করার একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলপথের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও দিন দিন বাড়ছে।
এক পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌপথে ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট আমদানি-রফতানি ছিল ৪৩.১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৩.২১ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
তিনি বলেন, তার সরকার জলপথের দীর্ঘমেয়াদী নাব্যতা বৃদ্ধি, নদী বন্দরগুলোর আধুনিকায়ন, নতুন বন্দর নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোগুলোতে জাহাজ ও যাত্রী ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং সকল নৌ যানের দক্ষতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
তিনি এক্ষেত্রে ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, দেশ-বিদেশে কন্টেইনার পরিবহনের উন্নয়ন, ড্রেজিং কার্যক্রম ও ফেরি সার্ভিসের সম্প্রসারণ, বন্দর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনার উল্লেখ করে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। ইতোমধ্যেই বিদ্যমান ভূমি এবং পানিসম্পদের উপর চাপ তৈরি হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে, আমরা নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রস্তুত করেছি এবং ইতোমধ্যে এর অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এই পরিকল্পনার অন্যতম উপাদান হচ্ছে পানি সম্পদের সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বাংলাদেশ ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার উপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমার ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সমুদ্রের ৩৫৪ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি সমুদ্র তলদেশের সম্পদ রয়েছে। সমুদ্রগর্ভ থেকে যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করা যাবে, তা বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ড থেকে আহরিত সম্পদের ৮১ ভাগ।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাতও এই সম্পদ আহরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয়া সামুদ্রিক ও লজিস্টিক ফোরাম ২০১৮ তে যেসব সুপারিশ প্রদান করা হবে, তা এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।’
বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা আনায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির প্রাপ্যতাসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জাতিসংঘ ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সনদ দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত প্রায় এক দশক ধরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ৭.৮৬ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ হতে ২০১৮ সালে ২১.৮ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা এ সময় তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।’
কালের আলো/এমএইচএ