২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা; মামলা, নাটকীয়তা এবং রায়

প্রকাশিতঃ 7:18 pm | October 10, 2018

সেন্ট্রাল ডেস্ক, কালের আলো:

সময় তখন ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের ২১ তারিখ বিকেল।  রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজন করা হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভার। সেখানেই বক্তব্য দিচ্ছিলেন  তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নামছিলেন তিনি, হঠাৎ বিকট শব্দ। মুহুর্তেই কেঁপে উঠে জনসভাস্থল, স্তম্ভিত হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে উপস্থিত নেতাকর্মীরা।

তখন একে একে বিস্ফোরিত হয় বেশ কয়েকটি গ্রেনেড। মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শুধু গ্রেনেড ছুড়ে ক্ষান্ত হননি ঘাতকরা। গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়তে থাকেন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে লক্ষ্য করে। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে দেন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের মাহবুব রশীদ।

মাহবুব রশীদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী। ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও জীবন রক্ষা হয়নি মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমানের। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ গুরুতর আহত হন। শরীরের বিভিন্ন অংশে ও মস্তিস্কে স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আহত হন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ। অন্যদিকে হাসপাতাল থেকে একের পর এক আসতে থাকে মুত্যু সংবাদ। একে একে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ এ।

ঘটনার পর আওয়ামী লীগের নেতারা একাধিক থানায় গেলেও তাৎক্ষণিক মামলা নেওয়া হয়নি। অবশেষে একদিন পর মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এছাড়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে পৃথক আরও দু’টি মামলা দায়ের করেন।

শুরু হয় বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। বিএনপি সরকারের আমলে গ্রেনেড হামলা মামলার অগ্রগতি নিয়ে উঠে নানা প্রশ্ন। বারবার পরিবর্তিত হয় তদন্ত কর্মকর্তা। যার ফলে তৎকালীন জোট সরকারের আমলে কোনো অভিযোগপত্রই দাখিল করা হয়নি। বিএনপি সরকার হামলার বছরখানেকের মধ্যেই তৈরি করে জজ মিয়া নাটক। নোয়াখালী থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে।

অবশেষে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে গতি পায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত। হামলার তিন বছর পর ২০০৮ সালে সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে ২০০৯ সালে অধিকতর তদন্তের অনুমতি দেয় ট্রাইব্যুনাল। এ সময় তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দকে। ২০০৯ সালে অবসান হয় জজ মিয়া নাটকের। পাঁচ বছর বিনা অপরাধে কারাভোগ করে ঘরে ফেরেন নিরপরাধ জজ মিয়া।

২০১১ সালে আবদুল কাহহার আকন্দ আগের ২২ জনের সঙ্গে আরও ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দু’টি অভিযোগপত্র দায়ের করেন। এতে উঠে আসে বিএনপির বহু রথি-মহারথির নাম। সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ অনেকের নাম।

অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে লন্ডন, ভারত, পাকিস্তানে পালিয়ে যান ৪৯ আসামীর ১৮ জন। তারেক রহমান লন্ডনে আর হারিছ চৌধুরী পরিবারহ এদেশ-ওদেশ করে জীবন কাটাচ্ছেন। এই মামলার অন্যতম আসামি ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক জিওএস-১ লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায় ও পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

এভাবে একের পর এক বছর গত হয়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বিশ্বজুড়ে। এ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আসামি পক্ষের আইনজীবীরা পাল্পাপাল্টি অভিযোগ করেন। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা এই মামলা দু’টি পাঁচ বার উচ্চ আদালতে নিয়ে যায়। এতে ব্যয় হয় ২৯২ কার্যদিবস। চার্জশিটের ৫১১ জন সাক্ষির মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য নেয় আদালত।

যুক্তিতর্ক চলে ১১৯ কার্যদিবস। অবশেষে ১৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

আদালত বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ মোট ১৯ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছেন। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার রায়ে প্রত্যেক আসামিকে বিভিন্ন অংকের অর্থদণ্ডও ঘোষণা করা হয়েছে।

কালের আলো/এনএলএম