ভোজ্যতেলের দামের রাশ টানতে সিরিজ বৈঠকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার

প্রকাশিতঃ 9:49 pm | March 08, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সরাসরি নাকচ করে দিলেও সিন্ডিকেটের কারসাজি থামেনি। সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারও হয়ে উঠেছে অস্থির। অতি প্রয়োজনীয় এই নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতেই সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ক্রেতার নাভিশ্বাস দূর করতে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন মন্ত্রী।

মন্ত্রীর টিপু মুনশির নির্দেশে এক্ষেত্রে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিজ বৈঠক করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) ঢাকা মহানগরীর পাইকারি ও খুচরা ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সভা করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য উইং প্রধান ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান। বিশেষ এই সভায় তিনি ভোজ্যতেল বিক্রিতে পাকা রসিদে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন। এমন রসিদ ছাড়া তেল বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি উচ্চারণের পর ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে দু’দিনের সময় চেয়েছেন। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভোজ্যতেল কেনাবেচায় আগামী শুক্রবার থেকে পাকা রসিদ ছাড়া কোনো ব্যবসা করা যাবে না।

একইভাবে বুধবার (০৯ মার্চ) দুপুরে সংশ্লিষ্ট ডিজি ভোজ্যতেলের মিল মালিক ও বাজার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আবারও বসার কথা জানিয়েছেন। কঠোর অ্যাকশনের পাশাপাশি সচেতনতা ও সবার সহযোগিতা নিয়েই ভোজ্যতেল নিয়ে দামের উর্ধ্বগতির রাশ টানতে চায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

পাকা রসিদে গুরুত্ব ও তিন মাসের আমদানি পরিশোধন ও বিক্রির তথ্য
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) দুপুরে ঢাকা মহানগরীর পাইকারি ও খুচরা ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিশেষ সভায় বসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান। সভায় উঠে আসে ভোজ্যতেল বিক্রিতে মিল মালিক, পরিবেশক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে কেউই কাউকে পাকা রসিদ না দেওয়ার বিষয়টি।

পাকা রসিদ অর্থ হচ্ছে ছাপানো রসিদ। অর্থাৎ, কোন দোকান বা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানাসহ ছাপানো কাগজের রসিদ। তবে এর বাইরে সাদা কাগজে সিল মেরে রসিদ বানানোর একধরনের রেওয়াজ রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। রসিদ ব্যবহার ও পণ্যমূল্য টাঙিয়ে রাখার বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে। এবার এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই হার্ডলাইনে রয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ।

পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভোক্তা অধিকার আইন, ২০০৯ বিষয়ক মঙ্গলবারের (০৮ মার্চ) বৈঠকেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই পাকা রসিদ। পাকা রসিদ কোন আইনে রয়েছে এই বিষয়টি জানতে চেয়েছেন অনেকেই। বিষয়টি খোলাসা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল। তাঁরা জানিয়েছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯’র ২১ (১) ধারায় উল্লেখ রয়েছে মহাপরিচালকের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর কথাও। এখানে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, ভোক্তা সাধারণের অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ এবং ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি করিবার লক্ষে সমীচীন ও প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত সকল কার্যক্রম মহাপরিচালক গ্রহণ করিতে পারিবেন।’

ভোক্তা অধিকার আইনের ২১ (২) উপধারা (১) এর (খ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ন হইতে পারে এইরূপ সম্ভাব্য কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, উহাদের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও তৎসম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ডিজির কাছে যেন সবাই পাকা রসিদ নিয়ে ব্যবসা করতে এজন্য সময় চান। পরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নির্দেশনা প্রতিপালনের জন্য দু’দিনের সময়সীমা বেঁধে দেন।

এই বৈঠকে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা শুধু স্লিপ বিক্রি করছি। অথচ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন নীতি আদেশ ২০১১ অনুযায়ী সেলস আদেশ কারও কাছে হস্তান্তরযোগ্য নয়।’

রাজধানীর নিউমার্কেটে বনলতা মার্কেটের ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি মৌলভীবাজারের হাজী মুসলিম স্টোর থেকে পাম তেল কিনেছি। কিন্তু এজন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কোন পাকা রসিদ দেওয়া হয়নি।’

দামের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে
এদিনের সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এস এম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘ভোজ্যতেল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিগত তিন মাসের আমদানি পরিশোধন ও বিক্রির তথ্য চাওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে যে পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ আছে, তাতে আগামী রমজান পর্যন্ত দেশে কোনো সঙ্কট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা হাত বদলের মাধ্যমে এই দাম বাড়াচ্ছেন, সঙ্কটের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছেন বলে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি আমরা।’

বিপণন ব্যবস্থায় কারও অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন ডিজি। তিনি বলেন, ‘দেশে পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল মজুত থাকলেও যারা কৃত্রিম সংকট বানিয়ে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেশে ভোজ্যতেলের দামের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে জানিয়ে সভায় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনায় সর্বাত্মক সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন অধিদপ্তরের এই মহাপরিচালক।

অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সারসংক্ষেপ
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার রাজধানীর চকবাজার থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় মুসলিম স্টোরকে ৪০ ধারায় ৫০ হাজার টাকা জরমিানা করা হয়।

শেরেবাংলা থানার শুক্রাবাদ ও রাজা বাজার এলাকায় একই দিন সহকারী পরচিালক আব্দুল জব্বার মন্ডলের নেতৃত্বে অভিযানে মর্ডান মেডেসিনকে ৩৭ ধারায় ৫ হাজার ও নিউ আত্না ফার্মেসিকে ৫১ ধারায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং সহকারী পরচিালক মাহমুদা আক্তার ৪৩ ধারায় বরিশাল হোটলেকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।

যাত্রাবাড়ী থানায় ফাহমিনা আক্তার স্থানীয় মা স্টোরকে ৩৮ ধারায় ৩ হাজার এবং সহকারী পরিচালক মাগফুর রহমান খান স্টোরকে ৪০ ধারায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। মোট ৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

কালের আলো/এসবি/এমএম