সরল উচ্চারণে অনেক বার্তা দীপু মনির

প্রকাশিতঃ 10:34 am | March 09, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাস্তবিক এক উচ্চারণই করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা.দীপু মনি। আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর অনেকের ইতস্ততভাব তুলে ধরেছেন। আয়েশি নয়, উঠে আসতে হয় সংগ্রাম করেই জানিয়েছেন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই।

বয়স্ক পুরুষের পরিবর্তে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করার পর বারবার শুনতে হয়েছে এই মন্ত্রী হওয়ার ‘যোগ্যতা’ তার আছে কীনা? খোদ গণমাধ্যমের বিস্ময়ের ঘোরে পড়ার এই বিষয়টি নিয়ে গত বছরও কথা বলেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। অথচ তার আগে-পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া অন্য কাউকে ‘যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। বিরত থেকেছে গণমাধ্যম। স্বভাবতই আক্ষেপ নিয়েই বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি।

ভোটে জিততে কালো টাকা বা পেশিশক্তি নয়, জনগণের সঙ্গে সংযোগকেই মুখ্য বলে উপস্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী।

নারীর সমানাধিকার ও সংগ্রামের বিশ্বজনীন প্রতীক ‘দ্য বোভোয়ার’ চেয়েছিলেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারীর ক্ষমতায়নে গোটা বিশ্বেই অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। শিক্ষায়-দীক্ষায় কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজের বন্দোবস্ত করেছেন। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সরকার নারীদের অর্থনৈতিক সাবলম্বীতা নিশ্চিত করতেও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

কিন্তু আজও একশ্রেণির মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়নি। নিজেদের চিন্তা-ভাবনাতেও পরিবর্তন আসেনি। এই শ্রেণিটিই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে একজন নারীকে, ডা.দীপু মনিকে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু সমুদ্র জয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাইডলাইনে দূরদর্শী কূটনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাফল্য নিশ্চিত করেছেন দেশের। তখন তাঁরাই সম্ভবত কপালে হাত দিয়েছেন, লজ্জাবোধ করেছেন।

আদতে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ডা. দীপু মনি জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপে উঠে এসেছেন। এলাম, দেখলাম বা জয় করলাম থিওরি প্রয়োগের কোন সুযোগই ছিল না তার। ওয়ান ইলেভেনের ঝড়ের মুখেও শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। হুমকি ধমকি বা কারও চোখ রাঙানোতে ভীত সন্ত্রস্ত হননি। আদর্শিক, মানসিক দৃঢ়তা নিয়েই পথ চলেছিলেন। পুরস্কারও পেয়েছেন। দল এবং সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপত্য স্নেহ পেয়েছেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হেকস/ইপার আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ চলাকালীন দলিত ও সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতার উপর প্রভাব অধ্যয়ন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর সমাজের দৃষ্টিভঙির বিষয়কে বিস্তৃত পরিসরেই তুলে এনেছেন নিজের ভাষ্যে।

তিনি বলেছেন, ‘২০০৯ সালে যখন আমাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তখন অনেকেই যেন ইতস্তত হয়েছিল। একটি পত্রিকা লিখেছিল কোন যোগ্যতায় দীপু মনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। আমি যখন দায়িত্ব নিয়ে বসলাম তখন সামনে দেখি কিছু ইতস্তত মুখ। তারানা হালিমের বক্তব্যের কথা স্মরণ করে বলেন যে, একজন নারী মন্ত্রীকে সবসময় তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় এবং লড়াই করতে হয়।’

দীপু মনি বলেন, যদি সেই সংগ্রামটা করে জয়ী হতে পারে তখন তার সামনে সম্ভাবনা আকাশ সমতুল্য। তিনি বলেন যে, একজন নারী বাধা আছে যেমন, তেমন অফুরন্ত সুযোগও রয়েছে। কালো টাকা এবং পেশীশক্তি দিয়ে নির্বাচনে জেতা যায়, এমনটি আমি মনে করি না। বরং নির্বাচনে জেতার আসল উপায় হলো জনগণের সঙ্গে সংযোগ।

জনগণের সঙ্গে সংযোগ করলেই নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় এবং সেটি নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নয়। তিনি বলেন যে, নারীর ক্ষেত্রে অনেকগুলো বাধা আছে কিন্তু সেই বাধাকে অতিক্রম করাটাই নারীর সহজাত ধর্ম হওয়া উচিত।’

গত বছরের অনুষ্ঠানে অপ্রতিরোধ্য কন্ঠে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অনভ্যস্ততার তো একটা বিষয় ছিলই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়ারে সাংবাদিকরা সব সময় বয়স্ক একজন পুরুষকে দেখেই আসছেন। কিন্তু হঠাৎ একজন নারী আসায়, যিনি তখন খুব বেশি বয়স্ক নন, সেটা দেখে একটা ধাক্কা লাগতেই পারে। কিন্তু আমার আগে বা পরে কোনও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা আছে কিনা সেই প্রশ্ন কোনও সাংবাদিক বন্ধু করেননি। এটি বারবার শুনতে হয়েছে এবং সব নারীকেই শুনতে হয়।’

নারী জাগরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার মতো বঙ্গবন্ধু কন্যাও নারীদের পথ দেখিয়েছেন। কোনদিক থেকেই নারীরা পিছিয়ে নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে একজন ভাষাবীরের কন্যা, প্রথিতযশা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, চিকিৎসক, আইনজীবী ও তুখোর বিতার্কিক ডা.দীপু মনিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সেই দায়িত্বে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন মন্ত্রী দীপু মনি। একই ধারাবাহিকতায় শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে ‘গলার কাঁটা’ প্রশ্নফাঁস বন্ধ করেছেন। অনেক সমস্যায় ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’র ভূমিকা পালন করেছেন।প্রাণবন্ত-উজ্জ্বল-সুন্দর-মানবিকবোধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

চলতি বছরের মঙ্গলবারওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আলোচনা সভায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশে নারীর অগ্রযাত্রার পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ব্যানবেইসের বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ৫৫ দশমিক ০৭ শতাংশ নারী। উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী মেয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষাপর্যায়ে মোট ৫৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নারী।

কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে চায় সরকার। এজন্য নারীর উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কন্যাশিশুর শিক্ষা, বাল্যবিয়ে নির্মূলসহ নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইন প্রণয়ন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে সরকার বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে থাকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশের ওপরে বাংলাদেশের স্থান।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী।

বলেন, ‘আশা করি, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে থাকবে বাংলাদেশ। খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ গ্রহণ করা হয়েছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বিশ্বের সব উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উড়বে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা।’

এ সময় মন্ত্রী নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ গড়ার মাধ্যমে চলমান উন্নয়নকে টেকসই ও চিরস্থায়ী করার শপথ গ্রহণ করার আহ্বান জানান।

নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়ার কথা উল্লেখ করে দীপু মনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট হতে স্নাতক ও সমমানপর্যায়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৭৫ শতাংশ নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে ২০১২-১৩ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত স্নাতক ও সমমান পর্যায়ে ৯ লাখ ৭১ হাজার ৮৭৩ জন নারী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি বাবদ ৪৭৬ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৭০০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

কালের আলো/এসবি/এমএম