নিশ্চিত হয়নি ধূমপানমুক্ত পরিবেশ
প্রকাশিতঃ 12:34 am | March 23, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ একজন ‘অধূমপায়ী’। জীবনের ৫৮ বছর এই বদঅভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। তামাক নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচারণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ ‘অধূমপায়ী’ তথ্যমন্ত্রী, রক্ষা করেছেন বাবার সঙ্গে দেওয়া ওয়াদা
প্রয়াত স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও কখনও ধূমপান করেননি। জীবদ্দশায় ২০১৪ সালের ২৯ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবসকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন অধূমপায়ী হিসেবে বক্তব্য রাখছি। জীবনে একটি সিগারেটও খাইনি। বাকী জীবনেও খাব না।’ জীবনের গোধূলীবেলাতেও সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। অধূমপায়ী হিসেবেই মাটির শীতল বিছানায় চির ঘুম দিয়েছেন।
সংসদ সদস্যদের স্বাস্থ্য সংগঠন ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর ১৫২ জন সংসদ সদস্যের স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছেন। ১৫৩ জন সংসদ সদস্য মিলে প্রধানমন্ত্রী বরাবর ই-সিগারেটসহ তামাক আইন সংশোধনের ডিও লেটার প্রদানের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক আশ্বস্ত করেছেন তামাক আইন সংশোধনের বিষয়ে।
প্রতিদিন ধূমপানের জন্য ১ মিনিট করে আয়ু কমছে, এমন তথ্য জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। ফলে ধূমপান আইন কার্যকর করার জোর দাবি উঠেছে। যেখানে-সেখানে ধূমপান করার প্রবণতার রাশ টেনে ধরার কথাও প্রাধান্য পাচ্ছে।
ধূমপায়ীদের কারণে অধূমপায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বেশি।প্রতিনিয়ত পড়ছেন বিড়ম্বনায়। দেশে এই সংখ্যাটি প্রায় তিন কোটি ৮৪ লাখ। তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।
দেখা গেছে, ধূমপায়ী-অধূমপায়ীর মধ্য অনেক সময় তর্ক-বিতর্ক বেঁধে যায়। ধূমপানবিরোধী সংগঠনগুলো তামাকজাত দ্রব্য কমানোর বিষয়ে মাঠে থাকলেও অধূমপায়ীদের জন্যে তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। প্রকাশ্যে ধুমপানের জন্য জরিমানার আইন থাকা সত্ত্বেও যত্রতত্র সিগারেটের সুখটানের প্রবণতাও কমছে না।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংসদ সদস্যদের স্বাস্থ্য সংগঠন ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপান করেন। তামাকের কারণেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মুত্যুবরণ করেছে।
গত বছর তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের তথ্য চিত্র : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫নং ধারা সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে হাটবাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায়। এমন কি হাসপাতাল এলাকাতেও এই আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। ধূমপানবিরোধী প্রচার-প্রচারণায় জনসম্পৃক্ততায় করে তরুণ-যুবাদের টানতে হবে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে জনমত নিশ্চিত করেই ধূমপানকে ‘না’ বলতে হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ নিজেও বলেছেন,’ যদি ক্যাম্পেইন ঠিকমতো না হয়, যদি আইনের প্রয়োগটা ঠিকমতো না হয় তাহলে আমরা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হব। তথ্য মন্ত্রণালয় তামাক বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিতভাবে এ নিয়ে ক্যাম্পেইন চালাতে পারলে আমরা লক্ষ্য অর্জনে সফল হব। তামাক নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচারণা দরকার।’
ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার রাস্তাঘাটে ফ্রিস্টাইলে বেচাবিক্রি চলছে বিড়ি-সিগারেট’র। ধূমপানও চলছে দেদারসে। বাসে-রেস্তোরাঁয় কেউ সিগারেট ধরালে অনেকেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। তাই ঢাকার অনেক রেস্তোরাঁর দেয়ালে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ’ এমন কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যাত্রীরাও এখন গণপরিবহনে খুব একটা ধূমপান করেন না। এক্ষেত্রে সবাই সচেতনতা প্রদর্শন করেছেন।
ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন এমন সমাজকর্মীরা জানিয়েছেন, বিড়ি-সিগারেট সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে। সিগারেটের দাম আরো বাড়াতে হবে। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে অন্যান্য দেশ বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়িয়ে রেখেছে। তারা সুফলও পেয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংসদ সদস্যদের স্বাস্থ্য সংগঠন ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ। এই সেমিনারে জানানো হয়, দেশের তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব) তামাক ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫.২ শতাংশ নারী।
দেশের ২০.৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। বিড়ি হাতে তৈরি এক ধরনের সস্তা তামাকপণ্য, যা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ (সার্বিকভাবে বিড়ি ধূমপায়ী ৫%) বিড়ি ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছে ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ এন্ড ওয়েলবিং।
এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩–১৫ বছর) মধ্যে, ৬.৯ শতাংশ কোন না কোন ধরনের তামাক ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে ছেলে ৯.২ শতাংশ ও মেয়ে ২.৮ শতাংশ।
১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৯ শতাংশ বতর্মানে ধূমপান করে। যাদের মধ্যে ছেলে ৪ শতাংশ, মেয়ে ১.১ শতাংশ।
এছাড়া ৪.৫ শতাংশ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। এর মধ্যে ছেলে ৫.৯ শতাংশ ও মেয়ে ২ শতাংশ। দেশে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২.৭ শতাংশ নাগরিক আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, ৪৯.৭ শতাংশ রেস্তোঁরায় এবং ৪৪ শতাংশ গণপরিবহণে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হন।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের (১৩–১৫ বছর) ৫৯ শতাংশ পাবলিক প্লেসে এবং ৩১.১ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
তামাককে ‘প্রাণঘাতী পণ্য’উল্লেখ করে সংগঠনটি জানায়, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যায় তামাকের কারণে।
তামাকের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মুত্যুবরণ করেছে। যা দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৩.৫ শতাংশ৷ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত।
জানা যায়, সরকার ২০১৫ সালের ১২ মার্চ সংশোধিত আইনের আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৫ পাস করে। সংশোধিত আইন ২০১৩ ও বিধিমালা ২০১৫-তে নারী-শিশুসহ সব অধূমপায়ীকে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে রক্ষায় কঠোর বিধান রাখা হয়েছে।
এ লক্ষ্যে ‘পাবলিক প্লেস’ ও ‘পাবলিক পরিবহনে’ ধূমপান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আইন বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে এ বিষয়ে সর্বস্তরের জনসাধারণের সচেতন হওয়ার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের ০৫ সেপ্টেম্বর তামাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) ও অ্যান্টি–টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) এর উদ্যোগে কোভিড-১৯ ও শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োজনীয়তা: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল ওয়েবিনারে শতভাগ ধূমপান বন্ধ নিশ্চিতে ছয়টি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এগুলো হলো উন্মুক্ত স্থানে (পাবলিক প্লেস) ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ করা, ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করা, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার বাড়ানো, সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) নামে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা এবং বিক্রির স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করা।
কালের আলো/বিএস/এমএ