বিষাদঘন সেই দিনগুলোতে ‘গৃহবন্দি’ ছিলেন বঙ্গমাতা

প্রকাশিতঃ 10:52 am | March 26, 2022

গোলাম কিবরিয়া মন্ডল, কালের আলো:

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৫ মার্চের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর বন্দি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। কঠিন এ সময়টিতে পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন। সর্বশেষ ছিলেন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে। দেশ দখলদারমুক্ত হওয়ার পরও তাঁদের মুক্ত হতে আরও কিছু সময় লেগেছে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা বেগম মুজিবের অবরুদ্ধ জীবন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাত। অন্ধকার শোবার ঘরটাতে বিছানায় শুয়ে শেখ সাহেব শুনছিলেন বাইরের বোমাবিধ্বস্ত ঢাকার আর্তনাদ।

উত্তেজনায় একেক সময় উঠে বসছিলেন তিনি। ঠিক এমনি এক মুহূর্তে গুলির একটি টুকোরা জানালা ভেদ করে খাটের পায়ের কাছের পায়া ভেদ করে ছোট ছেলে রাসেলের পায়ে আস্তে করে লাগে। অন্ধকারে হাতড়ে গুলিটা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন শেখ সাহেব। আর সেই দুঃসহ রাতেই নরপিশাচরা তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে তখন ছিলেন বেগম মুজিব আর তাঁর দুই পুত্র।

‘২৬ মার্চ-সারাটা দিন ছিল কারফিউ। গোলাগুলির শব্দ তখনো থামেনি। নিস্তব্ধ বাড়িজুড়ে যেন এক ভৌতিক বিভীষিকা মাথা খাড়া করে উঠেছে। সামনে ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে ফিট করে রাখা বড় বড় কামানের মুখগুলো একেবারে আমার বাসার দিকে। ভয়ে জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পারিনি। দুপুরে কারফিউর মধ্যেই এবাসা-ওবাসা করে বড় ছেলে কামাল এসে পৌঁছাল। নিচের ঘরে তখনো কয়েকটি ভলেন্টিয়ার ছেলে ছিল। সকলের জন্য কোনোরকম ভাত–ডাল রান্না করার জন্য বাবুর্চিকে বললাম, কিন্তু মন আমার রাতের কথা ভেবে অবশ হয়ে আসছিল। এর আগে বহুবার শেখ সাহেব বন্দী হয়েছেন, কিন্তু এবারের মতো অত বীভৎস লাগেনি তাঁর অবর্তমানে নিজেদের অবস্থা।’

রাত এল। সেই আঁধার কালো রাত। ইয়াহিয়া খানর সেই হিংস্রভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা বিবৃতি শুনে এককথাতেই নিজেদের অবস্থা বুঝতে পারলেন বেগম মুজিব। তাই কালবিলম্ব না করে ছোট ছেলে আর মেজ ছেলেকে নিয়ে পাঁচিল টপকে প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে বড় ছেলে কামাল এবং মহিউদ্দিন সাহেব পালালেন অন্যদিকের পাঁচিল ডিঙিয়ে। রাত ১১টা থেকেই তোপদাগার শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। কতকটা চেতন, কতকটা অচেতন অবস্থায় বেগম মুজিব ২৬ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে শুনলেন তাঁর আদরের বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দ। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত একইভাবে তারা বিধ্বস্ত করে বাড়িটাকে। সে রাতে ওভাবে না পালালে তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের ভাগ্যে কী যে ঘটত, আজও তিনি তা ভাবতে পারেন না।

২৭ তারিখ সকালে বাচ্চা দুটো সঙ্গে নিয়ে তিনি আবার পালালেন। পুরো দেড় মাস এবাসা-ওবাসা করেন। শেষে মগবাজারের এক বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ১৮ নম্বর রোডে এই বাসাটাতে নিয়ে আসে।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বঙ্গমাতা নিজের অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য নিয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই। ত্যাগের মনোভাব নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুকে শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছেন। সঙ্কট থেকে উত্তরণে দিয়েছেন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বলা চলে, ঘরে বাইরে বেগম মুজিবই ছিলেন জাতির পিতার পরামর্শক, উপদেষ্টা, সহচর আর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল।

শুধু তাই-ই নয়, দেশ ও জাতির কঠিন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে দলের নেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন। দফায় দফায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের প্রবল হুমকি-ধমকিও তাকে কাবু করতে পারেনি। উল্টো তিনি ছিলেন অকুতোভয়। কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত কর্মীদের কাছে পৌছে দেওয়ার কাজটির জন্যও তিনি ছিলেন প্রকৃত একজন গেরিলা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিজের বিভিন্ন বক্তব্যে মমতাময়ী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেই ‘আসল গেরিলা’ বলে অবহিত করেছেন। মা নিয়ে বলতে গেলে কখনও কন্ঠ ভেঙে আসে, আবার কখনও গর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দেশরত্নের দু’চোখ।

২০১৮ সালে বঙ্গমাতার জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার মা বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ছিলেন আসল গেরিলা।’

আন্দোলন কীভাবে করতে হবে সেটি তার মায়ের কাছ থেকেই শেখা উল্লেখ করে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার মা এমন গেরিলা ছিলেন, পাকিস্তানিরা কিন্তু তাকে ধরতে পারেনি। এমনকি কোনও রিপোর্ট লিখতে পারেনি তার নামে। তিনি ছিলেন আসল গেরিলা।’

বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জাতির পিতার আদর্শ বাস্তবায়নে কীভাবে নেপথ্যে থেকে তার মা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি।

যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি। জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি এবং সাহসের এক উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা। স্বামীর সব সিদ্ধান্তে মানসিক সহযোগিতা ছাড়াও বঙ্গমাতার পরামর্শ অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়েছে।’

কালের আলো/এসবি/এমএম