বিশাল ক্রোধ ও শ্রীলঙ্কা

প্রকাশিতঃ 10:59 am | May 18, 2022

মুনতাসীর মামুন :

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকস্মিক মরু ঝড়। নিজের ব্যক্তিগত ঘটনা-দুর্ঘটনা উধাও, উধাও বাংলাদেশের দুর্গতি আর তেল না পাওয়ার খেদ। এখন শুধু শ্রীলঙ্কা, শুধু শ্রীলঙ্কা। আমরা ছেলেবেলায় বলতাম, ‘সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ’। যে দ্বীপ হেলায় বাঙালি বিজয় সিংহ জয় করেছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন বোধি বৃক্ষের চারা। সেই দ্বীপের মানুষজন হয়ে গেলেন বৌদ্ধ।

গত এক সপ্তাহ ছিলাম চাঁদপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে, রাজশাহীতে গণহত্যা জাদুঘরের এক গবেষণা প্রশিক্ষণে, ছিলাম ঢাকায়। নানা পেশার নানা বয়সের মানুষজন, গাড়িচালক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। এক গাড়ির চালক চওড়া হাসি হেসে বললেন, দেখেছেন স্যার, কীভাবে এক সংসদ সদস্য অর্ন্তবাস পরে দৌড়াচ্ছেন। নওগাঁর এক যুবক বললেন, এক এমপি এমন দৌড়ালো যে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। রাজশাহী শহরের এক সাংবাদিক বললেন, দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন, ভাবুন একবার ব্যাপারটা। ঢাকার একজন বললেন, মেয়েজামাই, লোক লস্কর নিয়ে আমাদের পয়সায় মন্ত্রী জেনেভা যায় স্যার, তার ফেসবুক নাই? গোতাবায়ার বাড়ি, পারিবারিক জাদুঘর সব তছনছ স্যার, তার মূর্তি উপড়ে ফেলেছে।

আমার ফেসবুক নেই, আমি এসব দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত। আমার জ্ঞানের ভিত্তি টেলিভিশন ও পত্রিকা সংবাদ। যারা এসব কথা বলছিল, তাদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি, যেন ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে বা ঘটবে- এরকম একটা আনন্দ। এ মুহূর্তে যদি এরকম কিছু ঘটে তাহলে তারা হবে পরিতৃপ্ত। এদের অনেকে সরকার সমর্থক। আসলে কী ঘটছে এদের মানস জগতে যে জগৎ সম্পর্কে সরকারের নীতিনির্ধারক, প্রভাবশালী সামরিক বেসামরিক আমলাদের কোনো ধারণা নেই। এরকম ধারণা ছিল না, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা সরকার সমর্থক আমলাদের।

আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমার বা আমাদের জেনারেশনের কাছে এসব দৃশ্য কোনো বিস্ময়ের সৃষ্টি করেনি। নতুনদের করতে পারে। কারণ, গত এক দশক দেশে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যাতে শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। মির্জা ফখরুল ও বিএনপির কিছু নেতা উল্লাস প্রকাশ করে দেঁতো হাসি হেসে বলেছেন, এখানেও শ্রীলঙ্কা হবে। যেন এটি একটি মডেল। অবশ্য জনাব ফখরুলের যে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে তা নয়। বিএনপির অত্যাচারী শাসনের পর যে এরকম ঘটনা একেবারে ঘটেনি তা অস্বীকার করা মুশকিল।

ডেমরার সালাহউদ্দিনের কথা তো মির্জা সাহেব ভোলেননি নিশ্চয়। ডেমরার সংসদ সদস্য ছিলেন। তাকে একবার লোকজন পেটানোর জন্য এমন খেপলো যে তিনি দিলেন লম্বা এক দৌড়। নাম হয়ে গেল তার ‘দৌড় সালাহউদ্দিন’। এরশাদ পতনের পরও এমন ঘটেছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী হাওয়া হয়ে গেলেন। মস্তো বড় লে. জে. হো. মো. এরশাদ আশ্রয় নিলেন সেনানিবাসে যেমন মাহিন্দার এখন আছেন এক নৌঘাঁটিতে।

আরও পিছিয়ে যাই। যৌবনে, ১৯৬৯ সালে, মিছিল থেকে আগুন দেওয়া হলো আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি রহমানের বাসায়। ভাগ্যিস পাজামা একটা পরা ছিল তার। সেটি পরে পেছনের দরজা দিয়ে ভাগলবা। আবদুল গনি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে, শাহবাগে হাসান আসকারীর বাড়িতে দেওয়া হলো আগুন। মিছিলে আমরা তখন উল্লসিত। সে সময় দৌড়াদৌড়ি দেখেছি।

বাংলাদেশে এধরনের দৌড় প্রতিযোগিতা সব সময় হয়েছে। ক্ষমতায় গিয়ে বিভিন্ন দল তা ভুলে যায় আর কী! বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তা হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ভার্সাইয়ের প্রাসাদ তছনছ করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রী রিশ্যলুর কবর খুঁড়ে তার মাথার খুলি বর্শায় গেঁথে মিছিল হয়েছে, ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলবীর পতনের পর তার পিতার সমাধিতে প্রক্ষালন গৃহ করা হয়েছে। মানুষের ক্রোধ যখন বিশাল হয়ে ওঠে তখন এগুলো ঘটে।

যোগাযোগ মাধ্যমে যখন শ্রীলঙ্কার ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে তখন সরকারের মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি হওয়া সম্ভব নয়। বলা হয়েছে, ঋণের ফাঁদে পড়ে শ্রীলঙ্কার এ অবস্থা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণ ৫১০০ কোটি টাকা। এর সুদ দিতে শ্রীলঙ্কা এখন অক্ষম। অনেকে বলছেন, চীন এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ল বলে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলে অন্য কথা।

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ১০ ভাগ এসেছে চীন থেকে। জাপান থেকেও এসেছে ১০ ভাগ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মুদ্রা সংস্থা থেকে ৪৭ ভাগ ও বিশ্বব্যাংক থেকে ৯ ভাগ। তাহলে শ্রীলঙ্কা ও চীনের বিষয়ে যেটি বলা হয় সেটি ঠিক নয়। বাংলাদেশের বেশি ঋণ আমার জানা মতে, জাপান থেকে, বিশ্বব্যাংক থেকে। তারপর হয়তো চীন। এ মুহূর্তে এ স্ট্যাটিসটিক্স দিতে পারছি না। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি ভারতের সঙ্গে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও চীনের কথা বলা হয়।

আমার মনে হয়েছে এর পেছনে দুটি কারণ আছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। এক. ১৯৭১ সালে ঘাতকদের সহায়তা করেছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। খোন্দকার মোশতাককে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হলো আমরা একেকজনের আমলে কীভাবে কাজ করি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের নামে একটি ট্রাস্ট ফান্ডের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তার পরিবার থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বাকশালের পর বঙ্গবন্ধু তো তাকে বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক করেছিলেন। চীন তো স্বীকৃতিই দেয়নি বাংলাদেশকে, বঙ্গবন্ধুকে। এখন কি সেই লজিক অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চীনা ভাষার ক্লাস বন্ধ করে দেবে? বা জিয়াউর রহমান হলের নাম তো বদলালো না। বা যারা ১৫ আগস্ট আনন্দ করে সেই ছাত্রদলের রাজনীতি নিষিদ্ধ- সেটিতো কর্তৃপক্ষ বলল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজের। একক কোনো ব্যক্তির নয়। আমি জানি, ২০২৩ সালের নির্বাচনের যেমন অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তেমনি সেখানে ভিসি হওয়ার দৌড় শুরু হয়েছে। থাক সে প্রসঙ্গ।

দুই.
চীনাদের ঔদ্ধত্য। মাস কয়েক আগে চীনা রাষ্ট্রদূতের ঔদ্ধত্যপূর্ণ হুমকির কথা আমরা ভুলে যাইনি, এটি চীনের ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যেমন- এখনও তারা মনে করে পৃথিবীর মাঝখানে তার ঐশ্বরিক অবস্থান। এবং চারদিকে সবার কাজ তাকে পূজা করা। আরও দুটি ঘটনা চীনের বিরুদ্ধে গেছে। পাকিস্তানে গাওদিউর ও শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দর চীনকে লিজ দেওয়া। কিন্তু শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান সরকার ওই ধরনের চুক্তি করল কেন?

তিন.
চীনারা সব সময় খুনিদের বা ডিকটেটরদের পক্ষে। যেমন- দুটি দেশই চীন ও আমেরিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। এক্ষেত্রে আমেরিকার সঙ্গে চীনের মিল আছে। শ্রীলঙ্কার বিপর্যয়ের মূল কারণ, চীনরা নয় শ্রীলঙ্কার মানুষ ও রাজনীতিবিদরা। কয়েকদিন আগে লেবানন নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। পাকিস্তান সেদিকে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কাও যাচ্ছে। এসব দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এবং বিভিন্ন সরকার সেগুলো প্রশ্রয় দিয়েছে। সরকারগুলো এমন সব প্রকল্প নিয়েছে, যা তাদের অহংবোধকে তৃপ্ত করবে। সে সব দেশে সংসদ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট কর্তৃত্ববাদী। প্রকৃত গণতন্ত্র নেই। যে কারণে অর্থনীতি পরিচালিত হয় কর্তৃত্ববাদের অহংবোধ থেকে। সবচেয়ে বড় কথা কর্তৃত্ববাদ যা অনেককে ডুবিয়েছে, ডোবাবে।

শ্রীলঙ্কায় গোটাবায়া পরিবারের একজন প্রেসিডেন্ট, একজন প্রধানমন্ত্রী, ভাগনে ভাতিজরা বিভিন্ন মন্ত্রী। গণতান্ত্রিক ভাবেই সব হয়েছে কিন্তু মানুষ তা মেনে নিতে পারেনি। নিজেদের অহংবোধকে তৃপ্ত করতে। বড় বড় প্রকল্প নিয়েছে, যা থেকে আয় হবে কি না অনুরূপ তা চিন্তা করেনি। সবচেয়ে বড় কথা জাতিকে তারা বিভক্ত করেছে। আমরা যেমন বলি, বঙ্গবন্ধু বাঙালির মতো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তাই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল।

জিয়াউর রহমানের অপরাধ দেশকে তিনি বিভক্ত করেছিলেন। গোটাবায়া ও শ্রীলঙ্কানরা যেভাবে তামিলদের শুধু দমন হয় একঘরে করে রেখেছে তা দেশের জন্য শুভ কোনো বার্তা বয়ে আনেনি। মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এই দ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মতো। গোটাবায়া পরিবার বড় বড় প্রকল্পের নামে টাকা পাচার করেছে। এ অবস্থায় তারা পড়বে এটি ভাবেনি। আর শ্রীলঙ্কানরা তো তা সমর্থন করেছে।

বাংলাদেশে জিয়া পরিবার বা এরশাদ গোটাবায়ার মতো কাজতো করেছেন। মানুষকে দমন নিপীড়ন করে দেশ বিভক্ত করেছেন। সবাইকে মুসলমান বানাতে চেয়েছেন মোদী বা অমিত শাহ যেটি চাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য যে, আফগানিস্তানের মতো সিভিল সমাজকে তারা হেয় করেছে। তারা মন্ত্রী ও আমলাদের ওপর আস্থা রেখেছে। না হলে মির্জা ফখরুলরা যা বলছেন, এই সিভিল সমাজ তার উত্তর দিতো, যা আগেও দিয়েছে এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছে। মির্জা ফখরুলরা যে দেশকে প্রায় শ্রীলঙ্কা বানিয়েছিলেন সে কথা জোরালোভাবে কেউ বলতে পারছে না। কেন পারছে না, বুঝ হে সুজন।

শেখ হাসিনা পাকিস্তানায়ণ রোধ করেছেন, জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে দেননি। জঙ্গিবাদকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন। শেখ হাসিনা কোনো রকম সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেননি। ভারত যেখানে ধর্ম রাষ্ট্র হতে চলছে এবং যার প্রতিক্রিয়া হতে পারে বাংলাদেশ সেখানেও তিনি সতর্ক থেকেছেন। অথচ মিয়ানমার বা শ্রীলঙ্কার কথা ধরুন। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা হচ্ছে অহিংসা যেখানে তারা গ্রহণ করেছে সহিংসা এবং তা ধর্মের নামে চালাচ্ছে। যেটা হয়েছে পাকিস্তানে। এবং এখন ইসরায়েলে। হিটলার যেরকম ব্যবহার করেছিল ইহুদিদের সঙ্গে ঠিক তেমন ব্যবহার করছে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনির সঙ্গে। হিটলার ভেবেছিলেন তিনি বিশ্বজয় করেছেন। আজ তার নশ্বর দেহেরই কোনো খোঁজ নেই। পৃথিবীর কেউ সন্তানদের নাম রাখে না হিটলারের নামে।

আওয়ামী লীগের ডানপন্থিরা [যারা ধরে নেওয়া হয় পাকিস্তানিদের মতো ধর্মকে গুরুত্ব দেয় বেশি] হেফাজতের সঙ্গে ভোটের আশায় দহরম মহরমের তত্ত্ব দিয়ে দলের নীতিনির্ধারণে জিতেছিল কিন্তু হেফাজতরা তাদের ভোট দেয়নি, শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় নীতিকেও সমর্থন করেনি। উল্টো লিবারেলদের ভোট ও সমর্থন হারিয়েছে সরকার। বা সংশয় প্রকাশ করেছে তারা। পরে যখন হেফাজতিরা হাসিনার মাথায় বাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে তখন শেখ হাসিনা এই তত্ত্ব অনেকাংশে পরিহার করেছেন। এতে সামাজিক টেনশন অনেক কমেছে। সম্প্রতি বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বে ওয়াজী নেতাদের ধর্মবিরোধী ওয়াজ ও টাকা আদায়ের ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে দুদকে। নির্মূল কমিটির উদ্যোগে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সরকার এতে নাখোশ না হয়ে যদি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে ধর্ম ব্যবসায়ীদের দাপট আরও হ্রাস পাবে।

অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশে যেসব মহাপরিকল্পনা কার্যকর হচ্ছে তা আদৌ লাভজনক হবে কি না। পদ্মা সেতু লাভজনক না হলেও নিয়মিত অর্থ আসবে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু, মনে রাখা দরকার সরকার ব্যবসায়ী না। মানুষের কল্যাণেই তার কাজ করা মুখ্য। পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেল কি জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে না? হ্যাঁ, বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারবাহী হতে পারে। কিন্তু পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেল মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করবে। সরকারের প্রধান কাজই তো তা। আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের লাভ কী? কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি মানুষের কল্যাণে শেখ হাসিনার এটি শ্রেষ্ঠ কাজ।

এক যুগে শেখ হাসিনা যা করেছেন গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের জন্য তা কেউ করেনি। কিন্তু, তারপরও এখনও কেন মানুষ ভাবে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো কিছু হবে বা হলে মন্দ হয় না। এটির উত্তর খুঁজতে হবে তৃণমূলে, আওয়ামী লীগ নেতা ও আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যার ইঙ্গিত আগে দিয়েছি।

ধরা যাক, ফরিদপুরের কথা। সেখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন মন্ত্রী কী করেছিলেন তা পত্র-পত্রিকায় সবাই পড়েছেন। সেখানকার মানুষজন ভাবছেন, শ্রীলঙ্কা হলে এরা যখন দৌড়াবে তখন কী ভালোই না লাগবে। গাইবান্ধার এক ছাত্রনেতা শুনেছি তিনি এমপি হওয়ার ইচ্ছা করেন। তিনি বিভিন্ন কাজের জন্য টাকা নয় জমি নিচ্ছেন। সে এলাকার লোক তো শ্রীলঙ্কা করবেই।

ইউনিয়ন থেকে এমপি নির্বাচন যেখানে সব প্রার্থীকে মনোনয়নের জন্য টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশের সবাই এটা জানে শুধু নীতিনির্ধারকরা তা জানেন না। এরা স্বপ্ন দেখে মনোনয়নের জন্য যারা টাকা নিয়েছেন কিন্তু মনোয়ন দেয়নি কখন তারা তাদের তাড়া করবেন। বাংলাদেশে কারা হাওয়া থেকে টাকা নিচ্ছে এটি সরকার ছাড়া সবাই জানে। তবে, ওবায়দুল কাদের হঠাৎ বলে ফেলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ করে কোটি কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।’ [প্রথম আলো, ১৩.৫.২০২২] তার এই আবিষ্কারে সবাই আপ্লুত। আবেগে ভেসে সবাই জিজ্ঞেস করছেন, তারা যদি জেনেই থাকেন তখন কি ভেরেন্ডা ফ্রাই করছিলেন? রাজনীতিবিদরা নিজেদের ছাড়া সবাইকে বোকা ভাবেন।

গণহত্যা জাদুঘর থেকে রাজশাহীর সাকোয়ায় গণহত্যার একটি ফলক লাগিয়েছিলাম অনেক কষ্ট করে। কিন্তু শুনেছি, সেখানকার এমপি আয়েন উদ্দিন সেটিকে হাপিস করে দিয়েছেন। শুধু তাই না দৈনিক সমকালের খবর অনুযায়ী সেখানকার অনেকের জমিও তিনি হাপিস করেছেন। তো যাদের জমি গেছে, বা আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের কাজ করছি তাহলে তারা কী চাইবে? গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বলে মিলাদ করলেও এমপির অনুমতি নিতে হয়। তিনি নির্বাচিত সদস্য না সামন্ত প্রভু তা বোঝা অনেক সময় দুষ্কর হয়ে ওঠে।

সরকার জানে কি না জানি না, সবাই মনে করে রাজনীতি করলে দুর্নীতি করতে হবে। অবস্থা এমন যে, অডিটের এক কর্মচারী বলছিলেন, তিনি ওমরাহ করতে যাবেন তার আগে যেন কাজকর্ম সব সারা হয়। এসব বিএনপি আমলেও ঘটেছে। এখনও সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে তাহলে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে না কেন? খুব শিগগির দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বাড়বে। এর জন্য সরকার দায়ী নয়। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি দায়ী, একথা তো কেউ বুঝতে চাইবে না। নেতারা সেগুলো বোঝাবার চেষ্টাও করেন না।

হ্যাঁ, ভোটের সময় মেট্রোরেল বা পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব থাকবে। কিন্তু এটাও ঠিক ভোটের সময় নেতা, এমপি আমলারা কার সঙ্গে কী ব্যবহার করেছেন, কী ঘটনা ঘটিয়েছেন সেটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মেট্রোরেল বা পদ্মা সেতু তখন গৌণ হয়ে যায়। যে কারণে যে গোটাবায়া পরিবারকে মানুষজন ভোট উজাড় করে দিয়েছিল এখন তারা তাদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। বাংলাদেশে এ ধরনের এতো ঘটনা ঘটছে যে বিন্দু বিন্দুতে শ্রীলঙ্কার আকাঙ্ক্ষা মনে আসছে।

সরকার মনে হয় ব্যাপারটা এতোদিনে খানিকটা বুঝেছেন। কয়েকদিন আগে ৪৩ জনের এক বহর নিয়ে প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান জেনিভা গেছেন। ৪৩ জনের মধ্যে তার মেয়ে, মেয়ে জামাই, ছোট ভাই, চাচাত ভাইও আছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। তাই সহযোগিতার জন্য মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।’… ভাই ও জামাই ‘তারা দেখতে যাবেন, ঘুরতে যাবেন। সহজে তো ভিসা পাওয়া যায় না। তাঁরা থাকবেন না। চলে আসবেন।’ [প্রথম আলো ১১.৫.২০২২]

এ সংবাদ প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিদেশ সফরের নামে যা হচ্ছে তা বহুতব্য নয়। খিচুরি তৈরি থেকে পুকুর খনন, আবুধাবি বা মিশরে মুক্তিযুদ্ধের খোঁজ সব কিছু তো আমলাদের যেতে হবে। মন্ত্রীর কথাতো বললাম। এগুলো রাষ্ট্রের ভাব ও মূর্তি দুটিই নষ্ট করে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন বিদেশ যাওয়া মনে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া। এটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়।…কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকায় এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।’ [ঐ]

যা হোক, এ সংবাদটি তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যখন ডলার সংকট তখন ৪৩ জনের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ বোঝার জন্য জেনিভা যাত্রা! সরকার এ সংবাদের পরদিনই এ ধরনের সফর বন্ধ করে দেয়। এতে সামান্য কয়েক লাখ ডলার বাঁচবে। কিন্তু, বাচঁবে তো মানুষ তাতেই খুশি। সামান্য একটা ব্যবস্থা তাও কতো ইতিবাচক প্রভাব ফেলে- এটি সরকারকে বোঝাবার ক্ষমতা আমাদের নেই। খবরে দেখলাম, এ আদেশ কেউ মানতে চাইছে না। প্রধানমন্ত্রী জানেন কি না, এখন নির্দেশ না মানার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।

সরকার তিনমাসের আমদানি [বিলাস দ্রব্যের] নিয়ন্ত্রিত করেছেন এলসির মার্জিন বাড়িয়ে। রপ্তানি বেড়েছে কিন্তু আমদানিও বেড়েছে এবং তাতে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। সতর্কতা হিসেবে মানুষজন এটিকেও ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আসলে ছোট ছোট ক্রোধ জন্ম দেয় বিশাল ক্রোধের যেটি ঘটেছে শ্রীলঙ্কায়। আবার ছোট ছোট ক্রোধকে শান্ত করে ছোট ছোট ইতিবাচক পদক্ষেপ। তখন সবার মনে হয়, শেখ হাসিনা ছাড়া আছে কে আমাদের! মির্জার কথা তখন কেউ ভাবে না। ভোটের আগে যদি সরকারি দলের নেতারা এটি বোঝেন তো তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন শত বিপর্যয়েও এখানে শ্রীলঙ্কা হবে না।

লেখক: ইতিহাসবিদ। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।