সর্বাত্মক ত্যাগের মানসিকতার বার্তা সেনাপ্রধানের, দুর্যোগ মোকাবেলা করতে চান সম্মিলিতভাবেই

প্রকাশিতঃ 10:40 pm | June 19, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

বন্যায় মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে সিলেটে। শহর থেকে গ্রাম ডুবেছে বন্যায়। অচল জীবনযাত্রা। পানিবন্দি অগণিত মানুষ। ফলত সময়টি কথার নয়, কাজের বলেই মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। মানবতার জয়গান গেয়ে এমন দু:সময়ে সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব বলেও আশাবাদী উচ্চারণ ধ্বনিত তাঁর কন্ঠে।

নির্ভীক চিত্তে, আলোর পথরেখা অঙ্কন করে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে উজ্জীবিত করেছেন নিজ বাহিনীর সদস্যদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশনার কথা বলেছেন। নিজেদের সর্বোচ্চ প্রয়াসে বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে চান। দীপ্ত অঙ্গীকারও করেছেন সরকার ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে।

রবিবার (১৯ জুন) সিলেটের বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিবেকের জাগ্রত কন্ঠে মানবিকতার উজ্জ্বল আভায় পরশ পাথর হয়েই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্গতদের পাশে থাকার সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি সমুজ্জ্বল হয়ে উঠলো সেনাপ্রধানের কন্ঠের ঐক্যতানে।

বন্যায় সীমাহীন কষ্টের ঘূর্ণিপাকে সিলেটের মানুষ।বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্য সঙ্কট নিয়েছে চরম আকার। কঠিন এই দুর্যোগে বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে গত শুক্রবার (১৭ জুন) থেকে সিলেট অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই দিন-রাত একাকার করে চলছে কার্যক্রম।

সেনাবাহিনীর এমন মানবিক কার্যক্রমের পদক্ষেপ স্থানীয়দের মাঝে জাগিয়েছে আশার আলো। নিজ বাহিনীর সদস্যরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই বানভাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিপন্ন মানুষকে ‘নিরাপদ’ করতে ছুটছে অহর্নিশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বান্তকরণে সব রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

দায়িত্ব পালনে অনগ্রাউন্ডে তাদের কষ্ট কেমন, আবেগ-অনুভূতি, কীভাবে সেনা সদর দপ্তর থেকে তাদের আরও সহযোগিতা করা সম্ভব, বন্যা পরবর্তী সময়ের আগাম প্রস্তুতি- এসব বিষয় নিজ চোখে দেখতে রবিবার (১৯ জুন) হেলিকপ্টারে সিলেটে আসেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন।

আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে না পারায় এবং সড়কপথে লম্বা সময়ের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় এসে পৌঁছার ঝক্কির কারণেই গত দু’দিন সিলেটে আসতে পারেননি তিনি। সেনাবাহিনী মোতায়েনের তৃতীয় দিনের মাথায় এদিন সকালেই ছুটে গেছেন সিলেটে দুর্গতদের পাশে।

জেনারেল শফিউদ্দিন সিলেটের বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক ও নিকটবর্তী বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যার্তদের হাতে ত্রাণ সামগ্রী তুলে দেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলেন। দুর্গতদের কষ্টের দিনলিপি শোনেন এবং সব রকমের সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেন।

সেনাবহিনী প্রধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরলসভাবে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রাখা, জরুরি ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান এবং বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাত্মকভাবে আত্মত্যাগের মাধ্যমে সহায়তার কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন।

এ সময় সেনাবাহিনীর মাস্টার জেনারেল অফ অর্ডন্যান্স মেজর জেনারেল মো. আবু সাঈদ সিদ্দিক, ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হামিদুল হকসহ সেনা সদরের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা
এদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার কথাও জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী দুর্গত মানুষের সহায়তায় যা কিছু করা সম্ভব তা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, সাভারসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনাসদস্যদের বন্যার্তদের সহায়তায় নিয়োজিত করা হয়েছে। আরও অনেককে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সেনাবাহিনী দুর্গতদের পাশে থাকবে।’

‘সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বন্যার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেটা কাটিয়ে উঠতে আমরা সবাই কাজ করছি। সেনাবাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুধু সেনাবাহিনী না, সরকারের সব প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে’- যোগ করেন সেনাপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্গত মানুষের সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। তাদের সহায়তায় সেনাসদস্যরা কী পরিমাণ কষ্ট করছে তা নিজে দেখতে এসেছি।’

গণমাধ্যমকে সেনাপ্রধান বলেন, ‌‘সেনাবাহিনী এর চেয়ে ভালো কাজ করতে পারত কি না- আমরা এই আলোচনায় যেতে চাই না। আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। তবে বৈরী আবাহাওয়া, প্রবল স্রোত, টানা বৃষ্টি, নেটওয়ার্কহীনতা সত্ত্বেও সেনাসদস্যরা বন্যাকবলিতদের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।’

পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে
সেনাপ্রধান বলেন, ‘দ্রুত বন্যার পানি নেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ সহসা কমবে না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হবে। পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা ত্রাণ ও চিকিৎসা প্রদান শুরু করেছি। সেনাসদস্যদের বলেছি কষ্ট যতই হোক মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’

সেনাবাহিনী প্রধান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করি এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারব। তাই সেনা সদস্যদের সর্বাত্মকভাবে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে আন্তরিকতার কাজ করতে হবে।’ সেনাপ্রধান সুনামগঞ্জসহ বন্যা দুর্গত এলাকাসমূহে যাওয়ারও ঘোষণা দেন।

কী বলছে আইএসপিআর?
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, গত শুক্রবার (১৭ জুন) থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিলেট অঞ্চলের ১৭ পদাতিক ডিভিশন সিলেট জেলার সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জয়িন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলা এবং সুনামগঞ্জ জেলার সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারা বাজার, দিরাই ও জামালগঞ্জ উপজেলা এবং কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছে।

সেনাবাহিনীর অন্যান্য ফরমেশন থেকে সিলেট এলাকায় উদ্ধার কাজে সহায়তার জন্য বিভিন্ন নৌযান মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। একই সাথে নৌবাহিনীর একটি দল সিলেট এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণ করেছে।

নেত্রকোনার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে শনিবার (১৮ জুন) থেকে ১৯ পদাতিক ডিভিশন’র ১২৫ জন সেনাসদস্য নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, উদ্ধার কার্যক্রম, ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য মোতায়েন রয়েছে।

দু’বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার
আইএসপিআর আরও জানায়, শনিবার (১৮ জুন) সেনা সদস্যরা সুনামগঞ্জ থেকে এমআইএসটি’র ১৫ জন শিক্ষার্থী এবং রবিবার (১৯ জুন) সুনামগঞ্জের ছাতকে আটকে পড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছে।

এছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে ২০১০ জন বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। ৩ হাজার ৬২৫ জনকে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ও ২ হাজার ২০০ জনের মাঝে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি বন্যার্তদের মাঝে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পানি বিশুদ্ধকরণ ওষুধ বিতরণ এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেল গঠন করেছে।

সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনান্য সকল অঞ্চলের ফরমেশনসমূহ নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত জাতির আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

কালের আলো/এসবি/এমএম