পবিত্র হজ পালন ও হৃদয়ের পবিত্রতা
প্রকাশিতঃ 10:39 am | July 03, 2022
মাহমুদ আহমদ :
হজ একটি মহান আধ্যাত্মিক বিধান এবং ইসলামি ইবাদতগুলোর মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয় মানব জাতির জন্য (কল্যাণের) প্রথম যে ঘরটি বানানো হয়েছিল সেটি বাক্কায় অবস্থিত। এ ঘরটি বরকতপূর্ণ এবং বিশ্বজগতের জন্য হেদায়াতের কারণ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬)।
আল্লাহতায়ালার পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহ বা খানা কাবা এবং বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর পবিত্র রওজা মোবারক জিয়ারতের সাধ প্রতিটি মুসলমানেরই হৃদয়ে জাগে। হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা কোনো কিছুর সংকল্প করা। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা এবং কয়েকটি বিশেষ স্থানে আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) নির্দেশ অনুযায়ী জিয়ারত, তাওয়াফ, অবস্থান করা এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করা।
অনেকে এমনও রয়েছেন যারা একাধিকবার হজ করেন আর কয়েকবার হজ করা সত্ত্বেও তার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। নিজের মাঝে পবিত্র পরিবর্তনই যদি না আসে তাহলে এ হজ বৃথা। আমার পাশের ঘরের মানুষ না খেয়ে রাত্রযাপন করবে আর আমি হজ করতে যাব এ ধরনের হজকারীর কোনো মূল্য নেই আল্লাহর দরবারে।
পবিত্র কোরআনে ইবাদত সম্পর্কে এভাবে উল্লেখ রয়েছে ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজ করা সেসব লোকের জন্য ফরজ যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু যে এটা অস্বীকার করে সে জেনে রাখুক আল্লাহ জগৎসমূহের মোটেও মুখাপেক্ষি নন’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)। এ ইবাদত গরিব মুসলমানের জন্য ফরজ নয় এবং যার জানের নিরাপত্তা নেই তার ক্ষেত্রেও হজ ফরজ নয়। শুধু দৈহিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্যই এই ইবাদতকে ফরজ করা হয়েছে।
আল্লাহপাক যেহেতু বান্দার অন্তর দেখেন তাই তিনি অন্তকরণের হজকেই গ্রহণ করেন। যাদের অন্তর অপবিত্র তাদের সাথে আল্লাহপাকের যেমন কোনো সম্পর্ক নেই তেমনি তারা কোরআনের শিক্ষার ওপর আমলের ক্ষেত্রেও থাকে উদাসীন। যেভাব কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আসলে তাদের হৃদয় এ কোরআন থেকে উদাসীন। এছাড়াও তাদের আরও অনেক মন্দ কর্ম রয়েছে, যা তারা করে চলেছে’ (সুরা আল মোমেনুন, আয়াত: ৬৩)।
অন্যদিকে যারা মুমিন তাদের অন্তর থাকে পবিত্র আর এদের সম্পর্কেই আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুপ্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস। অতএব তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সুরা আল ফজর, আয়াত: ২৭-৩০)।
মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট। এমন অবস্থাকে বেহেশতি অবস্থা বলে, যে আত্মার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট সেই আত্মাও তার রবের প্রেমে এমনভাবে বিলীন ও একীভূত হয়ে যায় যে, এমন অন্তর তখন আর আল্লাহ ছাড়া কিছুই বুঝে না। আসলে যারা আল্লাহপাকের মুমিন বান্দা তারা ইহকালেই তাঁর কাছ থেকে ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা’ এই আহ্বানের ডাক শুনতে পায়।
হজের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজব্রত পালন করে আর কোনো ধরনের অশালীন কথাবার্তা ও পাপ কাজে লিপ্ত না থাকে সে যেন নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ অবস্থায় হজ থেকে ফিরে এলো’ (বুখারি ও মুসলিম)।
এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে অনেকেই পয়সার জোরে প্রতিবছর হজ সম্পাদন করেন আর প্রতি বছরের গুনাহ-খাতা মাফ করিয়ে আনেন। হজ পালন করলেই নিষ্পাপ হয়ে যাব, এমন এক অদ্ভুত মনমানসিকতাও আমাদের সমাজের অনেকের মাঝে বিরাজ করে।
মহান আল্লাহপাক যাদের হজ করার সামর্থ্য দান করেছেন তাদের উচিত কেবল আল্লাহকে লাভ করাই যেন উদ্দেশ্য হয় আর আগের সব দোষ-ত্রুটির ক্ষমা চেয়ে মুমিন-মুত্তাকি হয়ে বাকি জীবন যেন অতিবাহীত করে। আর যদি এমনটি হয় যে, হজ থেকে ফিরে এসে অগের মতোই জীবন পরিচালিত করতে থাকে তাহলে তার হজ করা আল্লাহর দরবারে কোনো মূল্য রাখে না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ পালনকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন,
‘হে মানুষ! অতি তাড়াতাড়িই তোমরা তোমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। অতএব সাবধান! তোমরা আজকের (হজের) দিনের পর পুনরায় পথভ্রষ্ট (গোনাহে লিপ্ত) হয়ো না।’ (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
অনেকে এমনও রয়েছেন যারা একাধিকবার হজ করেন আর কয়েকবার হজ করা সত্ত্বেও তার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। নিজের মাঝে পবিত্র পরিবর্তনই যদি না আসে তাহলে এ হজ বৃথা। আমার পাশের ঘরের মানুষ না খেয়ে রাত্রযাপন করবে আর আমি হজ করতে যাব এ ধরনের হজকারীর কোনো মূল্য নেই আল্লাহর দরবারে। এছাড়া যারা একবার হজ করেছেন তারা ইচ্ছে করলে অন্য কাউকে হজ পালন করার সুযোগ করে দিতে পারেন যার ফলে দুজনেই পুণ্য লাভ করতে পারেন।
ইতোমধ্যে আমাদের দেশ থেকে অনেকেই হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। যারা হজের উদ্দেশ্যে চলে গেছেন এবং যারা যাচ্ছেন তাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের আল্লাহপাক তৌফিক দান করেছেন তাই আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করুন, নিজেদের দোষ-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করার জন্য আল্লাহপাকের কাছে ক্রন্দনরত অবস্থায় দোয়া করুন আর এই সংকল্প করুন যে, হজ থেকে ফিরে এসে আমার দ্বারা যেন কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়, আমার হৃদয় হবে পবিত্র আর আমি যেন সবার জন্য শান্তির কারণ হই। আপনার উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় এবং নিজেকে বদলানোর থাকে তাহলে এই হজ আপনাকে আল্লাহর সন্তুষ্টিগুজার বান্দায় পরিণত করবে।
আল্লাহতাআলা সবাইকে সঠিক নিয়তে সুন্দর ও সুস্থমতে হজ পালন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট