৯৭ বছরেও জ্যোতির্ময় ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ
প্রকাশিতঃ 11:03 pm | July 31, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
বাঙালি জাতিসত্তায় তারাই গেঁথে দিয়েছিলেন আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলার কৃষ্টি-সভ্যতা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে আমৃত্যু করেছেন লড়াই-সংগ্রাম। জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। নিজেকে নিবেদন করেছিলেন মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন স্বত্ত্বায়। মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থেও স্বর্ণালি অধ্যায়ে মোড়ানো তার নাম। তিনি ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এই সহযোগী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অগ্রণী। দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের কর্মাধ্যক্ষ হিসেবেও।
আদর্শ ত্যাগ আর নিরাবরণ সাদামাটা জীবনে বিনির্মাণ করেছিলেন নিজেকে। ভাষার সংগ্রাম থেকে বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা এবং বাঙালির জাতিসত্তার সংগ্রামের এই অগ্নিসাক্ষী কার্যত হয়ে উঠেছিলেন এক অসামান্য আলোকবর্তিকা। জনমানুষের আশা ও আর্তির প্রতিভূ হয়েই থেকেছেন জীবনভর। বাঙালির চিন্তা-চেতনাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নির্মোহতায় থেকেছেন স্বাতন্ত্র্য। আদর্শে হিমালয় অটল থেকেছেন বলেই কীনা ৭৮-এ স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
মুজিব আদর্শের প্রতিজ্ঞায় সুদৃঢ় ও অনমনীয় থেকে হাসিমুখেই কারাগারকেই আপন ঠিকানা করেছেন। সামান্য সময়ের জন্যও ভেঙে পড়েননি। সামরিক শাসনের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে বারবার মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়েছে নানাভাবেই। তবুও তার মনোবল ছিল ইস্পাত কঠিন।
সততার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হওয়া শান্ত-সৌম্য চেহারার এই মানুষটি বেঁচে থাকলে আজ ৯৬ বছর বয়সী হতেন। আজ ১ আগস্ট তার ৯৭ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৫ এর এই দিনে চাঁদপুর জেলার রাঢ়ির চর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, প্রয়াত ভাষাবীর এম. এ. ওয়াদুদ ১৯৪৮ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগের আহবায়ক ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (১৯৪৮) ও কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার (১৯৫৬) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ৫২’র গোড়ার দিকে গড়ে উঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তিনি এই সংগঠনেরও আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে এটিই স্বেচ্ছাসেবক লীগ হিসেবে যাত্রা করে।
প্রয়াত এম এ ওয়াদুদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (১৯৪৯), সাপ্তাহিক ইত্তেফাক (১৯৪৯) ও দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৫৩) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিরও ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
ছাত্র-জনতার স্বপ্ন-সাহসের প্রতিচ্ছবি হয়েছিলেন এম. এ. ওয়াদুদ। ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দু’বার নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও একবার প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সহ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ১২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়ে লিখেছেন-“…ওয়াদুদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্পাদক হয়েছিল। যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবু ছাত্রনেতারা আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মত বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করেছে।”
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৪৮ সালে একবার এবং ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২০ শে আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন এম এ ওয়াদুদ। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারী করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার পর ছাত্র আন্দোলনকে স্থিমিত করার জন্য পুনরায় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন কারাগারের নির্জনকক্ষে।
১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তৎকালীন শাসকদের রুদ্ররোষের শিকার হয়ে দীর্ঘ দিন আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। ১৯৪৯ সালে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুসহ এম. এ. ওয়াদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।
ভাষাবীর এম. এ. ওয়াদুদ ১৯৪৭’র দেশবিভাগের পর থেকে ১৯৭১ পেরিয়ে ১৯৮৩’র ২৮ শে আগস্টে মৃত্যুবরণের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালির ভাষা, স্বাধীকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির সকল আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
ভাষাবীর লড়াকু নেতা এম এ ওয়াদুদ বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন ঠিক অবিকল যেন তাঁর কন্যা, শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনিও। ওয়ান ইলেভেনে নিজের বিশুদ্ধ রক্তের প্রতীকী স্বাক্ষর রেখেছেন। মঈন-ফখরুদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদের ঝান্ডা হাতে শেখ হাসিনার মুক্তির পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। রুখে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধু কন্যাও তার ত্যাগের মূল্যায়ন করেছেন। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের মধ্যে দু’মেয়াদে সুনাম ও সফলতার সঙ্গেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন ডা. দীপু মনি। চারবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সততার শক্তিতেই ষড়যন্ত্রকারীদের বারবার পর্যদুস্ত করেছেন। তাঁর বড় ভাই ডা. জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপু চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং ডায়াবেটিক ফুট সার্জারিতে দেশের একমাত্র বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসক। কর্মীবান্ধব রাজনীতিক হিসেবেও সুপরিচিত ভাষাবীরের কন্যা-পুত্র।
কালের আলো/এসবি/এমএম