ভয়াবহ গুজব সন্ত্রাস’র রাজনীতি

প্রকাশিতঃ 10:35 am | August 13, 2022

কালের আলো রিপোর্ট:

ঘটনাটি মাস খানেক আগের। রাজধানী ঢাকার একটি এলাকায় গুজব ছড়ানো হয় মসজিদে বিদ্যুৎ থাকবে না। এই গুজব ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মুসল্লিদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা বিষয়টি জানেন। তিনি মুসল্লিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং জানান, মসজিদে বিদ্যুৎ থাকবে না এরকম কোনো নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে নেই।

পরবর্তীতে ওই নেতা জানতে পারেন, স্থানীয় জামায়াতের একজন পলাতক নেতা টেলিফোনে কয়েকজন মুসল্লিদের বলেছেন, মসজিদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এরকম স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে গুজব ছড়ানোর হচ্ছে দেশজুড়েই। গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।

দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পরিকল্পিতভাবে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে অনলাইনে-অফলাইনে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সহজেই গুজব রটানো হচ্ছে। ফলে গুজব সন্ত্রাসই হয়ে উঠছে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ।

দেশের মানুষকে গুজবের হাত থেকে রক্ষা করতে বর্তমানে কাজ করছে বেসরকারি ৪টি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাসহ এএফপি ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগ। কিন্তু তারপরও গুজব পিছু ছাড়ছে না। বেসরকারি উদ্যোগে গুজব মোকাবিলা ও ফ্যাক্ট চেকের বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে গুজবে বিভ্রান্ত না হতে বারবার আহবান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে গুজবের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লোডশেডিং নিয়ে গুজবে কান না দিতে একাধিকবার দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন সরকারের প্রভাবশালী শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের টানা চারবারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি এমপি। সাম্প্রদায়িক উস্কানি নিয়ে স্বার্থ হাসিলের অপরাজনীতির বিষয়টিও তিনি খোলাসা করে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, গুজব, মিথ্যাচারের রাজনীতিই জামায়াত-বিএনপির সম্বল। এটিই তাদের রাজনীতির প্রধান উপজীব্য।

দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে-এই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সব সামাজিক মাধ্যমেই। দু’টি নামি গণমাধ্যমে ক’দিন আগে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাস্ট ফিলিং স্টেশনে ৪০০ টাকার বেশি মোটরসাইকেলে তেল দেয়া হচ্ছে না এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে ৩ হাজার টাকার বেশি তেল দেয়া হচ্ছে না।

পরবর্তীতে এই খবরটিকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় জামায়াত এবং সেখানে শুধু ট্রাস্ট পেট্রলপাম্পের কথাই বলা হয়নি, বলা হয়েছে পুরো বাংলাদেশেই এই নিয়ম করা হয়েছে এবং গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট। পরবর্তীতে বিপিসির চেয়ারম্যানের তীব্র প্রতিবাদ করলেও পত্রিকাটি এই ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেনি বা তাদের প্রতিবেদনের স্বপক্ষেও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়নি। যদিও জামায়াত নিয়ন্ত্রিত সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফরমগুলো থেকেও খবরটি উঠানো হয়নি। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়েই জামায়াত পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার একটি গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে সতর্ক করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাবে। যেন মনোবল, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তায় অবিচল বঙ্গবন্ধুকন্যা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত চক্র মূলত গুজবকেই হাতিয়ার করতে চায়। এই চক্রের প্রাইম টার্গেট গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরি করা, সাধারণ মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তোলা। এই গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যোগাযোগকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘ এক যুগ পরে আবার লোডশেডিং ফিরে এসেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষের সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার জন্য এবং জনঅসন্তোষ তৈরি করতেই চক্রটি আদাজল খেয়েই নেমেছে যেন!

অনেকেই বলছেন, বিএনপি বরাবরই রাজনৈতিকভাবে সরকারকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলত তারা গুজব নির্ভর রাজনীতিতে থিতু হয়েছে। কোন গুজব কখন ছড়ানো হবে সেটি নির্ধারণ করে দিচ্ছেন লন্ডনে পলাতক বিএনপির মূল নেতা তারেক জিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে এটি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

বছর তিনেক আগে জার্মানির প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে ‘ফেসবুকে গুজব, গুজবের ফেসবুক’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘এটা এখন প্রায় সবাই বলছেন যে ফেসবুক গুজবের একটি বড় জায়গায় পরিণত হয়েছে৷ আর সত্য ঘটনার চেয়ে গুজবই যেন ফেসবুকে ভাইরাল হয় বেশি৷ এই গুজবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অনেক অঘটনও ঘটছে৷’

সাবেক সচিব মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, দেশের সব স্তরেই এখন গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর এসব গুজব যেন মানুষ বিশ্বাস করে, সেজন্য গুজবগুলোকে ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে।’

গুজবের কার্যকারিতা যে অস্বীকার করা যায় না সেটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘হিটলারের প্রেস মিনিস্টার গোয়েবলসের সেই তত্ত্ব তো আমরা ভালোই জানি। তিনি বলেছিলেন, একটি মিথ্যা বারবার বলে সেটিকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তথ্যের শক্তি সম্পর্কে তিনি ভালোই অবগত ছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায়ও এটি আরো বেশি সত্য। এ নিয়ে মানুষের সচেতনতা যেমন প্রয়োজন, সরকারের সতর্ক থাকারও দরকার আছে।’

সূত্র জানায়, গুজব প্রতিরোধে বিটিআরসি, আইসিটি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রয়েছে একটি গুজব প্রতিরোধ কমিটি। এ ছাড়া তথ্য অধিদপ্তর সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পৃথক আরেকটি দল নিয়ে কাজ করছে যারা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ভুল তথ্য বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা মোকাবেলায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

তবে মূলধারার গণমাধ্যম গুজব ঠেকানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধী অশক্তিগুলোর জনগণের মধ্যে গুজব তৈরি এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সবসময় একটা উপযোগিতা আছে। এখন নতুনভাবে তারা সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। মূলধারার গণমাধ্যম গুজব ঠেকানোর জন্য এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। মূলধারার গণমাধ্যমের সত্য ঘটনার আলোকে সঠিক তথ্য তুলে ধরা নিশ্চিত করতে হবে।’

কালের আলো/এএ/বিএসবি