প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদী সফর

প্রকাশিতঃ 10:17 am | September 07, 2022

মোস্তফা হোসেইন:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার সুরাহা হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। বাণিজ্য বৈষম্য দূরীকরণে বড় রকমের সুফলও হয়তো আসবে না। তারপরও দুই দেশের জন্যই এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সহজ কথায় বলতে গেলে, তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিষ্ফল হবে এমনটাও বলা যায় না।

মতভেদ নিরসন না হলেও কিছুটা না কমার কারণ নেই। কারণ যে কোনো বৈঠকেই কিছু না কিছু ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু মতভেদ হ্রাসে সীমাবদ্ধ নয়। নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধনের বিষয়ও জড়িত। দুটি দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ও আছে।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ভারতের স্বপ্ন ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। উভয় দেশই উল্লেখযোগ্য কাল অতিক্রম করছে চলতি বছর। বাংলাদেশ তাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করলো, ভারত করলো ৭৫ বছর। সেই আলোকে দুটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার যে মহাপরিকল্পনা করছে তা অর্জনের জন্য দুটি দেশই দুটি দেশকে সহযোগিতা করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা জরুরিও।

এ বিষয়গুলো অর্জন করতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন হচ্ছে আস্থা অর্জনের বিষয়টি। দীর্ঘকাল ধরে কিছু অমীমাংসিত বিষয় দুই দেশের আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে পাকিস্তানি মতাদর্শ লালনকারীদের প্রতিবন্ধকতা। লক্ষণীয় যে, যতই আস্থার ঘাটতি কিংবা সংশয়ই থাকুক না কেন, স্বাধীনতা লাভের পর দুটি দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেগুলোর অনেকটাই সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন ফারাক্কার গঙ্গাবাঁধের কথা বলা যায়।

গঙ্গাবাঁধ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরি করেছিল বড় রকমের। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্বর্ণকাল বলে পরিচিতি গত শতকের সত্তরের দশকেও গঙ্গাবাঁধ নিয়ে দুই দেশের আস্থায় ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে দুটি দেশই বুঝতে পেরেছে বন্ধুত্ব দৃঢ় করতে হলে সমঝোতায় আসতে হবে, তখনই দুটি দেশের মধ্যে সমঝোতা তৈরি হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই গঙ্গাচুক্তি সম্পন্ন হয়। সীমান্ত চুক্তির বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করতে হয়।

১৯৪৭ থেকে তৈরি হওয়া সিটমহল নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ছিল তাও সমাধান হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরই উদ্যোগে। আর অবশ্যই বলতে হবে অন্যপক্ষ ভারতের সম্মতি এবং আন্তরিকতা থাকার কারণেই ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত হত্যা দুটি দেশের জন্যই সংকট তৈরি করেছিল, যা বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত আস্থা হারানোর বিষয়। বারবার কথা দিয়েও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়টি সুরাহা হচ্ছিল না। সর্বশেষ বছরকাল ধরে এই সীমান্ত হত্যা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। সুতরাং দুটি দেশের মধ্যে যে কঠোর আস্থার সংকট ছিল তা কমে আসতে থাকে এমনটা বলার সময় এসেছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোল খাওয়া চলছে, সেটি নিরসন করা উভয় দেশের জন্যই জরুরি। সেক্ষেত্রেও ভারতের দিক থেকেই উদ্যোগী হতে হবে। তারা পশ্চিমবঙ্গের ওপর দোষ চাপিয়ে অনেকটা মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সিটমহল চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতা হিসেবে আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ভারতকে তাদের ভূমি ফেরত দিলেও বাংলাদেশ ভারতকে দিতে দীর্ঘকাল ক্ষেপণ করেছিল। সেখানেও তাদের মামলা মোকাদ্দমার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সংসদে অনুমোদন করিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের পথে সবরকম পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিল। তিস্তা চুক্তির বিষয়েও একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রস্তুত থাকলেও ভারতীয় বক্তব্য হচ্ছে, তাদের রাজ্য সরকারের বিপত্তির বিষয়টি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানবেন কি মানবেন না এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে বাংলাদেশ নাক গলাতে পারে না। যখন দুটি দেশের মধ্যে সমঝোতা হবে তখন তা বাস্তবায়ন দুটি দেশেরই কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার। সেক্ষেত্রে একটি দেশের স্থানীয় মতভেদ থাকলে তা নিরসন সংশ্লিষ্ট দেশের দায়িত্ব। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করতে চায়-ভারতের অভ্যন্তরীণ মতভেদ দূর করা তাদের পক্ষে সম্ভব এবং এজন্য প্রয়োজন হচ্ছে আন্তরিকতা।

আস্থা মজবুত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে দুটি দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টিও। নিকট প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় দুটি দেশের সামাজিক ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দুটি দেশেরই স্থিতিশীলতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট থেকে উত্তরণের মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিণতিতে বাংলাদেশে যে জ্বালানি সংকট চলছে, ভারত আমদানিকৃত জ্বালানি থেকে বাংলাদেশকে রফতানি করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দরকষাকষি করতে পারে ভারতের সঙ্গে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা হ্রাস করার ক্ষেত্রে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না সাম্প্রতিককালে কানেক্টিভিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন আমাদের প্রতিবেশী দেশটির উন্নয়ন সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ভাগ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। সেপা চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ভুটান ও নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করতে গেলে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে ভারতকে সহযোগিতা করছে, তেমনি ভারত নিশ্চয়ই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দুটি দেশেরই সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে। সেটা দুটি দেশের বাইরে অন্য কাউকেও যদি যুক্ত করতে হয় সেটাও আরও গুরুত্বসহ ভাবতে হবে।

দুটি দেশের নাগরিকদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। তার মধ্যেও দুটি দেশই ভালো-মন্দ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়াটা কতটা মসৃণ হবে কীভাবে সুন্দর করা যাবে তা নির্ভর করে দুটি দেশের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা মাধ্যমে।নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যে দীর্ঘ টানাপোড়েন তার বড় প্রমাণ দীর্ঘদিন নদী কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক না হওয়া। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে সেটিও অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ৫-৭টি সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষরের কথা শোনা যাচ্ছে।

সুতরাং আশা করা যায় কিছুটা সুপরিবর্তন হয়তো আসবে। যেহেতু দুটি দেশেই নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তাই দুটি দেশই সাবধানে পথ চলবে এটাও স্বাভাবিক। এই সফরে সুফল হিসেবে বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাবে না কিন্তু আরও কিছু খাত আছে, যা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়কেই লাভবান করতে পারে। অন্তত করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করবে। কতটা দিতে হবে, কতটা পাওয়া যাবে তা স্পষ্ট হতে এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক: কলামিস্ট