সাফ চ্যাম্পিয়ন : আমাদের ফুটবল

প্রকাশিতঃ 9:25 am | September 25, 2022

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :

ফিফা র‌্যাংকিংয়ে ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি। র‌্যাংকিংয়ে ১৮৬তম অবস্থান নিয়ে ২০২২ শুরু করেছিল বাংলাদেশ। মার্চ পর্যন্ত কোনো ম্যাচ খেলেনি। এরপর ফুটবলে ব্যস্ত হলেও সময়টা সাফল্যহীনই কেটেছে। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের আগে তিনটি প্রীতি ম্যাচে কোনো জয় পায়নি, হেরেছে মালদ্বীপের বিপক্ষেও। সর্বশেষ জুন মাসে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে তুর্কমেনিস্তানের কাছে ২-১ ব্যবধানে হেরে র‌্যাংকিংয়ে ১৯০-এর পেছনে চলে গেল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ফুটবলের ক্রমাগত অবনতির কারণ কী? সুদীর্ঘকাল ধরে দেশের ফুটবলের দৈন্যদশা ক্রমেই যেন আরও প্রকট হচ্ছে। অথচ, তা নিয়ে খাপছাড়া কথাবার্তা বলা ছাড়া বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন -বাফুফে সভাপতি ও কর্মকর্তাদের কোন ভাবনাচিন্তা আছে বলে কোন কিছু দৃশ্যমান নয়। সাবেক তারকা ফুটবলাররাও এই বিষয়ে খুব বেশি‌আগ্রহ দেখান না, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

একটু হলেও ভাবতে হবে ফুটবলের ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেশ। এখনই ফেডারেশনের উচিত কোন সফল দেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে জাতীয় ফুটবলের কাঠামো ঢেলে সাজানো। জানিনা তারা বুঝতে পারছেন কিনা যে, এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলাটাই উঠে যাবে।

কবে এ দেশের মানুষ অপর দেশের প্রশংসা ছেড়ে নিজের দেশের ফুটবলকে আপন করে নিতে পারবেন? এমন একটা জিজ্ঞাসা ছিল বহুদিন। তার একটা বড় উত্তর এনে দিল বাংলাদেশের মেয়েরা। সত্যি বলতে কী ফুটবলসহ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিগত বছরগুলোতে বড় সাফল্যের প্রায় সবই এসেছে মেয়েদের মাধ্যমে।

এবার সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়শিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে ধসিয়ে দিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি আমরা। এই শিরোপা জয়ে দেশবাসী স্বভাবতই আনন্দিত ও উল্লসিত।

অনেকদিন পর, বেদনার আবহে থাকা দেশবাসী যেন একটু উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখল এবং দেখালো। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করায় দেশে ফিরলে রাজসিক সংবর্ধনা পেলো তারা। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিলে বাফুফে ভবন পর্যন্ত তারা ছাদখোলা বাসে করে গিয়েছে, রাস্তার দু’ধারে আর বাসের সামনে পিছে জনতা উল্লাস ধ্বনি দিয়েছে।

কিন্তু যাদের পেছনে বিনিয়োগ অনেক বেশি, অনেক নিয়মিত অর্থ ব্যয় সেই ছেলে ফুটবল দল শুধু ব্যর্থ হয় কেন? বাংলাদেশের দলের কাছে হারার সাথে সাথেই ব্যর্থতার দায় নিয়ে নেপালের নারী দলের কোচ পদত্যাগ করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ছেলেদের ফুটবল (যেটাকে আবার বলা হয়) জাতীয় দল, যত নাকানিচুবানিই খেয়ে থাকুক না কেন, কাউকে কখনও দায়িত্ব নিয়ে সরে যেতে দেখা গেল না।

তবে সাফল্য এলে যে দখলবাজ হতে হয় ফেডারেশন কর্মকর্তারা, আমাদের মন্ত্রণালয়ের কর্তারা সেটা ভালো করে জানেন। তাইতো দেখা গেলো বাফুফের সংবাদ সম্মেলনে পেছনের দিকে কোন রকমে মুখ দেখাতে পারছেন কোচ ছোটন আর অধিনায়ক সাবিনা।

সামনের সাড়িতে বসে আছেন মন্ত্রণালয়, বাফুফের কর্তাব্যক্তিরা যাদের গলায় আবার ফুলের মালা! বিজয়ী দলের ক্যাপ্টেনকে পেছনে রেখে সবাই সামনের সারি দখল করে রেখেছেন এমনটা দেখেছেন কেউ কোন দেশে?

বাফুফে সভাপতি, অনেক দূর অতীতের তারকা খেলোয়াড় কাজী সালাহউদ্দিন, আজ ১৪ বছর ধরে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। তিনি প্রায়ই বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখেন বা দেখান। কিন্তু বিশ্বকাপ তো অনেক দূরের কথা, এশিয়ান পর্যায়েও দীর্ঘ কাল কোন পাত্তা নেই বাংলাদেশের। এমনকি নেপাল, আফগানিস্তান, মালদ্বীপের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও সাফল্য আসেনা সেভাবে।

সত্যিটা হলো কাজী সালাহউদ্দিনের মতো তারকা ফেডারেশন সভাপতি হওয়ার পর দেশের ফুটবল নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতেও শুরু‌করেছিল ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু তিনি হতাশ করেছেন কিনা বা তার সময়টা ভাল গেলনা কেন, সেসব প্রশ্নের চেয়ে বড় সত্যিটা হলো আমাদের ফুটবল তার সময়ে সাফল্যহীন।

বিশ্ব দরবারে আমাদের ফুটবল মান এখনও হতাশাজনক। নারী দলের সাফল্য এক পাশে সরিয়ে রাখলে সভাপতি হিসেবে তার ১৪টি বছরে দেশের ফুটবলের রুগ্ন চেহারাটাই বের হয়ে এসেছে আরও বিবর্ণভাবে। চরম অবনতির পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়নি দেশের ফুটবলকে।

ফুটবল নিয়ে তার পরিকল্পনা কী, অবকাঠামোগত উন্নয়ন কতটুকু করতে পেরেছেন, সারাদেশে কেন লীগ হয় না- এসবের কোনো স্বচ্ছ জবাব নেই কোথাও। তবে নিজে এবং তার সাথীরা জাতীয় দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণও খুঁজে পান বলে মনে হয় না।

মানুষের যে ফুটবল প্রেম আছে সেটা বোঝা গেল নারীদের সাফ জয়ের পর বিপুল সংবর্ধনা দেখে। তাই তারা টানা চার ঘন্টা ধরে সংবর্ধনা দিয়েছে নারী চ্যাম্পিয়নদের।

খেলোয়াড়ি জীবনে দুর্দান্ত স্ট্রাইকার ছিলেন কাজী সালাহউদ্দিন। এবং তাদের সেই সময়টায় আমাদের ঘরে ঘরে ফুটবলের আলাপ ছিল। সে সময় রাজত্ব করতো আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স- ওয়ান্ডারার্স। মাঝে মাঝে জ্বলে উঠতো ওয়ারি, রহমতগঞ্জ। কিন্তু সেই ফুটবল আর নেই। তবে ফুটবলের আবেগ ঠিকই আছে।

ফুটবল বিশ্বকাপ এলে আবেগের স্রোত বয়ে যায় দেশজুড়ে। রাত জেগে আমাদের মানুষ ইউরোপীয় ফুটবল, কোপা আমেরিকার মতো টুর্নামেন্ট দেখছে। বাফুফে কর্মকর্তারা ভেবে দেখতে পারেন এদেশের মানুষকে কী আজীবন ফুটবলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন বা ফ্রান্সের মতো দেশকে সমর্থন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে? ফুটবলের বড় মঞ্চ না হোক, মাঝারি মঞ্চেও কোনদিন যেতে পারবে না বাংলাদেশ?

একটু হলেও ভাবতে হবে ফুটবলের ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেশ। এখনই ফেডারেশনের উচিত কোন সফল দেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে জাতীয় ফুটবলের কাঠামো ঢেলে সাজানো। জানিনা তারা বুঝতে পারছেন কিনা যে, এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলাটাই উঠে যাবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।