মূর্খের দশ মিনিট মূর্খপণ্ডিতের দশ বছর
প্রকাশিতঃ 10:36 am | October 05, 2022
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম:
প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা করা মানুষগুলো সবাই পণ্ডিত গোছের। সবকিছু হিসাব করেই তারা সাধারণত প্রকল্প পাওয়ার আবেদন করেন। সেখানে কাগজপত্রের সাথে কাজ শেষ করতে সময়ের বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করা থাকে।
সে অনুযায়ী কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও কাজটি সমাপ্ত করতে গিয়ে আরও বড় পণ্ডিতি ফলাতে শুরু করেন। এটাকে তারা লাভ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে মনে মনে সব সময় পোষণ করেন। এতে সবার ক্ষতি হয় কিন্তু সেসব পণ্ডিতের লাভের অংকে পকেট ভারী করার অপচেষ্টায় কোনো হেরফের হতে দেখা যায় না।
শিক্ষিত বেকারদের চাকরির বয়স শেষ। পেটের ক্ষুধা হলেও মনের ক্ষুধার টানে বিয়ের বয়স তো আর শেষ করে ফেলা যায় না। তারা বাবা-মায়ের অনুরোধে বাধ্য হয়ে অভাব সাথে নিয়ে ঘর বাঁধে। কেউ ঘরজামাই হয়। বাবা-মাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও স্বার্থের টানে, অভাবের লজ্জায় একসময় নাড়ির টানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। নিঃসঙ্গতা ও সামাজিক এবং মানসিক হতাশার সাথে লড়াই শুরু হয় তাদের।
তারা ভালোভাবে জানেন যে ছাগল দিয়ে হালচাষ করা যায় না। কারণ, ছাগল কাদা-পানিকে ভয় পায়। একটু বৃষ্টির ফোটা গায়ে পড়লেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ শুরু করে ঘরে ফেরার জন্য। তবুও ওইসব পণ্ডিতরা ছাগলসদৃশ লোকবলকে কাজে লাগিয়ে কাজ উদ্ধার করতে তৎপরতা দেখান। আর কোনো সমস্যা হলে নিজের দোষ ও অপারগতা ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখেন। এতে প্রকল্পের অহেতুক দীর্ঘসূত্রতা ঘটে ও ব্যয় বেড়ে যায়।
তাদের সেসব কথা জবাবদিহিতার অধীনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে শুরু হয় লবিং, ড্যাশিং, ঘুস-দুর্নীতির মহড়া। এতে একটি চক্র বা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায় পুরো বিষয়টি। জড়িয়ে পড়ে রাজনীতি-প্রশাসন, গণমাধ্যম, আইন সবকিছু। শুরু হয় জটিলতা ও আরও বেশি দীর্ঘসূত্রতার অন্তর্জাল। ফলে কাজ শেষ করতে আরও দেরি হয়- শুরু হয় জননির্যাতন ও ভোগান্তির চরম দিকগুলো।
এটা আমাদের দেশে সরকারি টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করার সবচেয়ে নাজুক ও ক্ষতিকর দিক। টেন্ডার ব্যবস্থাপনা একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে আবর্তিত হওয়ায় এবং সেটার কোনো ইতিবাচক সংস্কার না হওয়ায় সরকারি কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় ও বার বার ফ্যাসাদ বেঁধে জটিলতা তৈরি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে ঝুলে থেকে টাকা ও সময় দুটোই নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে তর্কের আগা-মাথা খুঁজে পাওয়াটাও বেশ দুষ্কর। তখন সেসব পণ্ডিত মূর্খের মতো বিতর্ক শুরু করেন। সেসব পাগলকে ভালো করার কোনো ওষুধ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হতে শোনা যায়নি। কারণ তারা দলে ভারী। তাদের দলে হালুয়াভোগী অবৈধ স্টেকহোল্ডাররা তাদের সমর্থন জানিয়ে নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
তা-না হলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোনোর ঘটনা সৃষ্টির সম্ভাবনা জড়িত। তাই এসব পরিস্থিতিতে সব শিয়ালের একই রা’ শোনা যায়। এসব পণ্ডিতরূপী মূর্খরা গোপনে বৈঠক করেন। লাল পানীয়ের চুমুকে নানা ফন্দির কথা প্রকাশ করেন। তাদের তর্কের ভাষা খুবই জটিল কিন্তু বেশ মজার। কেউ যদি বলে- হাতি উড়তে পারে তাহলে সাগরেদরা সেটা শুনে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে হাততালি দেন।
তাদের অনুসারীরা সেগুলোতে বাহবা দিয়ে আসর জমিয়ে রাখেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ যদি বেশি পণ্ডিতি করে উত্তরে বলে যে, হ্যাঁ আমি সচক্ষে দেখেছি। হাতিটি আজ রাতে উড়ে এসে আমাদের দশতলা ছাদবাগানের কলাগাছ খেয়ে ফেলেছে। এজন্য তখন তাকে সন্দেহ করা হয। তাকে বহিষ্কার করা হয় আসর ও দল থেকে। কিন্তু এই বহিষ্কারাদেশের ফলে তাদের তর্ক অ্যাকচ্যুয়াল আসর ছাড়িয়ে লিকেজের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে গেলে বিপদের আবহ তৈরি হয়। গণপ্রতিরোধ সৃষ্টির ভয়ে তাদের ক্ষমতাধর সরকারি স্টেকহোল্ডাররা সেগুলোকে লবিং করে অনলাইন থেকে দ্রুত মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
এটাই চরম বাস্তবতা। এটাই একনায়কতন্ত্র। এটাই অধিকার চুরি করার আসরের আলোচনা। যিনি এ কথার বিরোধিতা করবেন তাকে এক ফোঁড়ন নয়- পাঁচ ফোঁড়ন দাও। লেলিয়ে দাও পোষা পেটোয়া বাহিনী তার বিরুদ্ধচারণ করতে।
কারণ, সন্দেহযুক্তরা ভিন্ন মাফিয়া, অন্যদের ফেলো। আর ওই আসরের বংশবদ অনুসারীরা সবাই বাফেলো। তারা বুনো বাফেলোর মতো মালিকের নির্দেশে ওদের বিরুদ্ধে শিং উঁচু করে তাগিয়ে আসার জন্য সদা প্রস্তুত। ওরা মোটা মাসোহারার সাথে আরও সুবিধা যা চায় তাই পেতে পারে। তারা চা খেতে চাইলে পেয়ালাটা যদি একটা গোটা চৌবাচ্চার সমান হয় তাহলেও সেই সম পরিমাণ চায়ের আব্দার পূরণ করা হয়। এটাই তাদের একচোখা গণতন্ত্র।
তাই তো তারা অলস, অকর্মণ্য হয়েও ভাগবাটোয়ারা পায়। সেজন্য বসে বসে খেতে ভালোবাসে। তারা নিজেদের ওপর অর্পিত কাজ বা দায়িত্ব সম্পন্ন করতে মোটেও তৎপর নয়। তারা জিরো টলারেন্সের বাণী এককানে শোনে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। তাদের জবাবদিহিতা কে নিশ্চিত করবে? তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে এতবড় নিয়ামক সংস্থা কি দেশে আছে? যদি থাকে তাহলে তাদের ফাইলে হাত দিয়ে দেখুক- কত ধানে কত চাল বের হয়!
অন্যদিকে শিক্ষিত বেকারদের চাকরির বয়স শেষ। পেটের ক্ষুধা হলেও মনের ক্ষুধার টানে বিয়ের বয়স তো আর শেষ করে ফেলা যায় না। তারা বাবা-মায়ের অনুরোধে বাধ্য হয়ে অভাব সাথে নিয়ে ঘর বাঁধে। কেউ ঘরজামাই হয়। বাবা-মাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও স্বার্থের টানে, অভাবের লজ্জায় একসময় নাড়ির টানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। নিঃসঙ্গতা, সামাজিক ও মানসিক হতাশার সাথে লড়াই শুরু হয় তাদের।
তাদের অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। একদিন বাঁচার তাগিদে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। সময় কাউকে ক্ষমা করে না। জীবনযাত্রার মানের নিম্নগতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই যুগে তাদের কাছে সবকিছু পানসে মনে হয়। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। বেড়ে যায় পারিবারিক সংঘাত। শহুরে জীবনে এই সমস্যাগুলোর দিকে সেবাদানকারীরা তাকানোর সময় পায় না। গ্রামীণ জীবনে এগুলোর প্রতিকার নিয়ে কারও কোনো বিকার নেই।
কারণ, যারা একবার নানা কায়দায় চাকরি নামক সোনার হরিণ বা মেগা প্রকল্পের সোনার খনি হাতে পেয়েছে তাদের বিছানার জাজিমটা বেশ নরম। তাদের সকালের সূর্যটা অনেক দেরিতে ওঠে। তারা অনেক বেলা পর্যন্ত আয়েশ করে ঘুমিয়ে কাটান। তাদের নিজস্ব সেবাদাস-দাসীরা তাদের জন্য বিলাসী খাদ্য-পানীয় ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করে রাখেন। আমাদের শহর-গ্রামের আয়বৈষম্য, দুর্নীতির ব্যাপকতা ও সম্পদের মেরুকরণতা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে এই দূরত্বকে আরও ঘনীভূত করে ফেলেছে।
এভাবে মূর্খের মধ্যে পণ্ডিতি ঢুকিয়ে দিয়ে সততা ও জ্ঞানের গণ্ডিকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। তাই কোনো প্রকল্পের কাজই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। মাদকের অনুপ্রবেশ ও ব্যবসা বন্ধ হয় না। ব্যবসায়ীরা জিনিসের দাম কমান না। শিক্ষক সময়মতো পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে জমা দেন না, ফলাফল প্রকাশ করেন না। থানা, বিআরটি, পাসপোর্ট অফিস কোথাও ঘুস বন্ধ হয় না। মানুষ টাকা খরচ করেও সুচিকিৎসা সেবা পায় না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বাণী শূন্যতায় না গিয়ে আবারো চেনা ডিজিটে উঠে মানুষকে নাজেহাল করে। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথকে অসম বিন্যাসে হিসাব করে বঞ্চিত, ক্ষুধার্থ, দিনমজুর মানুষকে শীতাতপ গণমাধ্যমের বাক্স থেকে মাথাপিছু আয় বাড়ানোর প্রতারণার বক্তব্য শোনায়।
এই বৈপরিত্যের মাঝে আমাদের নিত্য বসবাস চলছে। আমদের মূর্খরা পণ্ডিত সেজে অপদার্থের মতো আজগুবি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে চলছে। পণ্ডিতরা মূর্খ হয়ে ঘরের কোণায় চুপিসারে কালাতিপাত করছি। রুমি বলেছেন, যখন পণ্ডিতরা রাজার কাছে ধরনা দিতে দরবারে যাবে এবং নিজের বক্তব্য দিতে না পেরে শুধু হ্যাঁ-হুঁ করে হলে আসবে তখন সেই দেশে দুর্নীতি ও দুর্যোগ বাসা বাঁধবে।
আগেকার দিনে রাজা-বাদশারা জনগণের দুয়ারে আসলে অবস্থা নিজ চোখে দেখতে আসতো। এখন তারা চাটুকারের কথা শুনে, নিজেরা জনগণের দুয়ারে যায় না। আজকালকার জ্ঞানীরা একটি সামান্য পদের আশায় রাজার কর্মচারীদের দুয়ারে দিন-রাত ধরনা দেয়। নিজেদের যোগ্যতার যোগ্যতা ও আত্মমর্যাদার প্রতি সম্মান জানাতে জানে না। তাহলে তাদের এসব জ্ঞান দিয়ে কি হবে? তাই তো এখন সবাই মূর্খের দলে শামিল। কেননা, কেউই এখন ভেবে চিন্তে কোনো কিছু করতে চায় না।
সবাই শুধু নিজের ধান্ধা করে উদভ্রান্তের মতো চলাফেরা করে। অন্যায়ভাবে কাজ বা দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়ে অপরিণামদর্শিতার জন্য দণ্ডিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে লজ্জা ও অপমানের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই অধিকার তাদের কে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এর পেছনে কর্তৃপক্ষের আস্কারা রয়েছে। এর ইতিবাচক সুরাহা হওয়া আশু প্রয়োজন। সেটাকে ক্রমাগতভাবে অবহেলা করলে পণ্ডিতরা মূর্খ লোকের মতো কাজে অবহেলা ও দুর্নীতি করবে আর অন্যকে দোষ দিয়ে নিজের অপারগতা ঢাকার চেষ্টা করে দশ মাসের জায়গায় দশ বছরেও কোনো সমস্যার সুফলদায়ক সমাধানে সহায়তা করতে সমর্থ হতে পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।