জলপাই রাঙা ক্যাপে স্বকীয়তায় জ্যোতির্ময় প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনীকে আন্তরিকভাবে দেশসেবার আহ্বান
প্রকাশিতঃ 9:45 pm | October 13, 2022

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
মাথায় সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির গর্ব-অহঙ্কারের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জলপাই রাঙা ক্যাপ। নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে নির্ধারিত সময়েই ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাতে অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত লিখিত বক্তব্য। কিন্তু তিনি যে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন সেটি লিখিত নয় মোটেও। সহজ, সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবেই দূরদৃষ্টির পরিচয়বহ, নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠ, দিকনির্দেশনামূলক ও সুমিত ভাষায় জ্ঞানোদ্দীপক প্রায় ২৯ মিনিটের এক বক্তব্য।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে দেশের সর্বোচ্চ সেবায় আত্মত্যাগে প্রস্তুতের বার্তা সেনাপ্রধানের
উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রায় শক্তিশালী ও সক্ষম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কথা তিনি যেমন বলেছেন তেমনি বীর সেনাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তরিকভাবে দেশের সেবা করবে বলেও দৃঢ় আশাবাদের কথা উচ্চারণ করেছেন। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও পরিপূর্ণ অনুগত থেকে কঠোর অনুশীলন, পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে অভিভাবকের মতোই নির্দেশনা প্রদান করেছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জাতির মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’র মান রক্ষা করা সকল সৈনিকের পবিত্র দায়িত্ব।
দেশের প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেনাবাহিনীর প্রশংসনীয় ভূমিকা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা, সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও উৎকর্ষতায় নিজ সরকারের অব্যাহত যুগান্তকারী সব উদ্যোগ, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ-কোন কিছুই বাদ যায়নি বাঙালি জাতির আশার বাতিঘর, কান্ডারি বঙ্গকন্যার অমূল্য-অনন্য এক ভাষণ থেকে।
সরকারপ্রধানের এই বক্তব্যটি অন্যরকম নতুনত্ব ও জ্যোতির্ময়তায় ভাস্বর, যা তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনুপ্রেরণা সঞ্চারী। স্বত:স্ফূর্তভাবেই নিজের মনের কথাই তিনি বলেছেন সেনাবাহিনী তথা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে। আর হবেই বা না কেন? সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্ক নিবিড়, অবিচ্ছেদ্য।
নিজের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও শেখ জামালের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া আর দশ বছর বয়সী ছোট্ট রাসেলের সেনা কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছার কথা বলতে গিয়ে ভিজেছে তাঁর চোখ। মুহুর্তেই বেদনায় ভারী হয়ে উঠে গণভবন থেকে অনুষ্ঠানস্থল সাভার সেনানিবাসে সিএমপি সেন্টার এন্ড স্কুলে সদর দপ্তরের পরিবেশও। কিন্তু দেশের মানুষের গভীর ভালোবাসাই যে তাঁর শক্তি। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস।

ফলে মানসিকভাবেই আবার নিজের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার কথাই জানান দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশাবাদী উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে নিজের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার কথাও উচ্চারণ করেন। বলতে থাকেন-‘দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরি। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি। ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি।
‘২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করছি’ বলছিলেন বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার এই মূর্ত প্রতীক।
এসব ঘটনা প্রবাহ বৃহস্পতিবারের (১৩ অক্টোবর)। এদিন সকালে সাভার সেনানিবাসে সিএমপি সেন্টার এন্ড স্কুলে সদর দপ্তর ৭১ মেকানাইজড ব্রিগেড, ১৫ ও ৪০ ইষ্ট বেঙ্গল (মেকানাইজড) এবং ৯ ও ১১ বীর (মেকানাইজড) এর পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নবতর চেতনায় কোটি কোটি মানুষের হৃদয়কেই প্লাবিত করেছেন বঙ্গবন্ধুর এই রক্তের উত্তরাধিকার। অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ৭১ মেকানাইজড ব্রিগেড’র পতাকা উত্তোলন করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, মাস্টার জেনারেল অব অর্ডন্যান্স মেজর জেনারেল মো. আবু সাঈদ সিদ্দিক, নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক এবং ১১ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও বগুড়ার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. খালেদ-আল-মামুন অন্যান্য ইউনিটসমূহের পতাকা উত্তোলন করেন।

প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ বক্তব্য শেষে তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এ সময় আর্টডকের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল এস এম কামরুল হাসান এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হক তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
অনুষ্ঠানে এক পলকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও মর্যাদা, যা বহি:র্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল করেছে বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘আবহমানকাল থেকেই যুদ্ধের ময়দানে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’ বহন করার রীতি প্রচলিত আছে। পতাকা হল জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। তাই পতাকার মান রক্ষা করা সকল সৈনিকের পবিত্র দায়িত্ব।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। এছাড়া এ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছি।
দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। তিনি বলেন, ‘গত ৪ বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে ৩টি ব্রিগেড এবং ছোট বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলছে।’
চার মেয়াদে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্ত করেছি। তাছাড়াও অত্যাধুনিক এম.বি.টি.-২০০০ ট্যাংক, অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাংক ভিটি-৫, এম.এল.আর.এস রেজিমেন্ট, মর্টার রেজিমেন্ট, সেল্ফ প্রোপেল্ড রেজিমেন্ট, এম.আই.-১৭১ এস.এইচ. হেলিকপ্টার ও কাসা সি-২৯৫ ডব্লিউ এর মত অত্যাধুনিক পরিবহন বিমান, অত্যাধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেটিস-এম-১, বিমান বিধ্বংসী মিসাইল এফ.এম.-৯০ এবং আধুনিক পদাতিক সৈনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেছি।’

সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের পাশাপাশি ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে একের পর এক সেনাশাসন, হত্যা ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অতীত ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস মুছে যায়। একের পর এক সেনাবাহিনীতে ক্যু হতে থাকে। সামরিক বাহিনীর অফিসার সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লাশ গুম করে দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, এখনও সেদিন গুম হওয়াদের স্বজনহারারা কেঁদে বেড়াচ্ছে সেই বেদনা নিয়ে। ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে সে সময়কার সেনাশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এক রকম জোর করেই প্রবাস জীবন কাটানোয় বাধ্য হওয়া অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন এবং সেনাবাহিনীর এই সদস্যদের হত্যার প্রতিবাদ করেন বলে জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন, ‘আমি সশস্ত্র বাহিনীতে আর কোন ছেলেহারা মায়ের ও স্বজনহারা পিতার কান্না এবং সন্তানের আহাজারি শুনতে চাইনা। আর কোন বিধবা দেখতে চাইনা।’ সরকারের আসার পর দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় দেশের আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য চিত্রও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পেক্ষাপটে বৈশ্বিক মন্দার কথা উল্লেখ করে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোর আহবান অনুষ্ঠানে পুণর্ব্যক্ত করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্রিগেড ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদাতিক ব্যাটালিয়নকে মেকানাইজড হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আজ তাদের বহু প্রতীক্ষিত পতাকা উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেকানাইজড ইউনিট সংযোজনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমি আশা করি, জাতীয় নিরাপত্তা ও ঝুঁঁকি মোকাবেলায় এই মেকানাইজড ইউনিটসমূহের সংযোজন এক নতুন মাত্রা যোগ করবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রধানমন্ত্রী একটি সুশৃঙ্খল ও মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ উপহার দেয়ার জন্য সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এ মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনায় যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের সকলের জন্য রইল আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। এছাড়াও আজকের এই অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে আয়োজন করায় তিনি সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
কালের আলো/এমএএএমকে