শৈশব স্মৃতিমাখা গ্রামে সেনাপ্রধান, উন্নয়নের দৃশ্যকাব্যে প্রাণোচ্ছ্বল আপন ভুবন

প্রকাশিতঃ 11:33 pm | November 08, 2022

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

প্রাণবন্ত শৈশবের স্মৃতিমুখর গ্রামে তাঁর উপস্থিতি। কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধে স্বচ্ছতার আলোয় উদ্ভাসিত মঙ্গলবার (০৮ নভেম্বর)। স্নিগ্ধ মায়ার বাঁধনে জড়ানো অপরূপ বাংলার একখণ্ড প্রতীমা করফা। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়নের গ্রামটিতে এসে স্বভাবতই আবেগাত্মক, প্রাণোচ্ছ্বল ও উদ্বেলিত প্রাণের আকুন্ঠ প্রকাশ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড. এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ’র।

দুরন্ত প্রাণময় শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়েই নিজের জবানীতে তুলে আনলেন, ‘করফা গ্রামে আমার পৈত্রিক ভিটা।’ সময়টা তখন সকাল-দুপুরের ঠিক মধ্যখানে আটকে। জীবনের প্রত্যুষে স্বাধীনতার স্বপ্নভরা চোখে এখানেই বেড়ে উঠেছেন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শেখ মো. রোকন উদ্দীন আহমেদের গভীর দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনায় আগুন ঝরানো উদ্দীপনা দেখেছেন নিজ চোখেই।

ইতিহাসের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিংবদন্তিতুল্য তীব্র আহ্বান চেতনার স্ফূলিঙ্গ জ্বালিয়ে সংগ্রামের মশাল প্রজ্বলিত করেছিলো শেখ মো. রোকন উদ্দীন আহমেদ’র আপন ভুবনকে। একটি মুখের হাসির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। মানুষের মনে জাগিয়েছিল স্বাধীনতার আশার বাণী। বৈচিত্র্যময় করফা গ্রামের কোমল খাঁটি প্রাণ আর সজীব মাটির দীপ্তি ছড়িয়ে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় করফা গ্রামে ছিলাম আমি। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার বাবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।’

এই নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সারথি তাঁর বাবা ‘অধ্যাপক শেখ মো. রোকনউদ্দিন আহমেদ ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র’ গড়ে উঠছে। জীবনসঙ্গী নূরজাহান আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার (০৮ নভেম্বর) এই নির্মাণ চিত্র পরিদর্শন করেন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

চলতি বছরের জুলাই থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (এইচইডি)। আগামী বছরের ১৫ মার্চের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হলে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে নব দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে জানান অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশির আহমেদ।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, পরে নিজের বাবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এস এম রোকনউদ্দিন আহমেদের হাতে গড়া মল্লিকপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কার্যক্রম পরিদর্শন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এস এম রোকনউদ্দিন আহমেদ ভবন উদ্বোধন করেন সেনাপ্রধান। বিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী প্রধানকে মানপত্র প্রদান করা হয়।

একটি টিনশেড থেকে মল্লিকপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গৌরবময় বিকাশের কথা জানিয়ে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, ‘আমার আজও চোখে ভাসে আমি একাত্তর সালে এখানে ছিলাম। এই স্কুলটি ওই সময় ছিল টিনের ঘর। মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় ভিত। আজ এটিকে বিশাল এক মহিরুহই মনে হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আমরা উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত বন্দরে নোঙর করতে পেরেছি।’

বদলে যাওয়া নড়াইলের চিত্রপট নিজের চোখেই দেখেছেন সেনাপ্রধান। এক সময় যে জেলা ছিলো অবহেলিত এখন সেখানেই ঝকঝকে দালান, সুপ্রশস্ত সড়ক আরো কত কী! সার্বিক অবকাঠামো আর দৃশ্যমান উন্নয়নে দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার গল্পই যেন বলে চললেন। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতা ও অকুতোভয় মনোভাবকে উপস্থাপন করেন মোটা দাগে। গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রজ্ঞাবান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।

আবেগ মথিত কন্ঠে বলতে থাকেন ‘এটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার আজকে আমি আমার স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে দাঁড়িয়ে আছি সেনাপ্রধান হিসেবে। আমি পুনরায় বলতে চাই এটি মহান সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমি মানুষের দোয়া পেয়েছি বলে আমি আজকে এই জায়গায় আসতে পেরেছি। আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।

যিনি আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে দায়িত্বই দেননি, সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন করার জন্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা।’

এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এছাড়াও লোহাগড়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা ‘অঙ্কুর’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন সেনাবাহিনী প্রধান। এরপর তিনি লোহাগড়া সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে যান, সেখানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

নড়াইলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার (০৮ নভেম্বর) মধুমতি আর্মি ক্যাম্পের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করতে নড়াইল সফর করেন। এ সময় তিনি মধুমতি রেলওয়ে ব্রিজের কাজের অগ্রগতি এবং বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন। তিনি কালনা এলাকায় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

পরে সেনাবাহিনী প্রধান আসন্ন শীতকালীন প্রশিক্ষণ উপলক্ষে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের প্রস্তাবিত প্রশিক্ষণ অপারেশন ও লজিষ্টিকস’র প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।

পরিদর্শনকালীন সময় এডহক কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট’র চিফ কনসালটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল এ কে এম রেজাউল মজিদ ও ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও যশোরের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ মাহবুবুর রশীদসহ যশোর এরিয়ার ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

সেনাপ্রধান দিনমান ব্যস্ত সফরে গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণ কাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। এতে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমের ৯টি জেলা সংযুক্ত হবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে