বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের মিলন মেলা, শক্তিশালী-সমৃদ্ধ সেনাবাহিনীর দৃঢ় প্রত্যয় সেনাপ্রধানের

প্রকাশিতঃ 10:23 pm | November 22, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর ঠাণ্ডা মাথায় হিংস্র দানবের মতো হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাক সামরিক বাহিনী। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাক হানাদারের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা।

পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও। মূলত তাদের অসামান্য ভূমিকায় অর্জিত হয় প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। নি:শঙ্কচিত্তে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করেন সশস্ত্র বাহিনীর ১ হাজার ৫৩২ জন বীর সেনানী। এর মধ্যে ৫ জন পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা। অনন্য খেতাবে ভূষিত করা হয় ৩৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনিতে প্রজ্বলিত হয়ে শত্রু সেনাদের খতম করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করা জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা- যাদের সবাই সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের হাতে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) আয়োজিত সংবর্ধনায় উপহার তুলে দিয়ে সম্মাননা জানান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড. এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

এ সময় ২০২১-২২ সালে শান্তিকালীন সময়ে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ, প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মোট ৩০ জন সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যকে অসামান্য ও বিশিষ্ট সেবা পদক তুলে দেন সেনাপ্রধান। এবার ১০ জনকে ‘অসামান্য সেবা পদক’ (ওএসপি) এবং ২০ জনকে ‘বিশিষ্ট সেবা পদক’ (বিএসপি) এ ভূষিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এদিন ঢাকা সেনানিবাসস্থ ‘আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে’ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের সম্মানে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরত্বগাঁথা এবং শান্তিকালীন পদকপ্রাপ্তদের প্রশংসনীয় কর্মকান্ডের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়। বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রাণপণ লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মর্মবাণীই যেন উচ্চারিত হয় অনুষ্ঠানটির প্রতিটি ক্ষণে।

জাতির বীর সন্তানদের এই মিলনমেলায় মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরেই আলোকিত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পানসিতে চড়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থেকে শক্তিশালী ও আধুনিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সেনাপ্রধান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া সেনাদের সবসময় গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর তাদের উত্তরসূরীরাই এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে। এ সময় শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন সেনাপ্রধান।

তিনি বলেন, ‘এই দেশকে স্বাধীন করতে যারা সেক্রিফাইস করে গেছেন তাদেরকে অবশ্যই আমাদের স্মরণ করতে হবে। আপনাদের সেই দিনের ত্যাগ, সেইদিনের অসীম সাহসিকতা আজকে আমাদের এখানে দাঁড় করিয়েছে।’

শান্তিকালীন পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি এই পদকপ্রাপ্তি আপনাদের কাজের সঠিক একটা রিকগনিশন এবং এটা আপনাদের ভবিষ্যতে আরও উৎসাহ নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে।’

আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, এমনটি উল্লেখ করে সেনাপ্রধান জনগণের আস্থার প্রতীক হয়েই সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে বলেও আশ্বস্ত করেন। তিনি দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হওয়ার বিষয়াদিও তুলে ধরেন। সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য শান্তিকালীন সময় প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথাও জানান।

জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসমারিক প্রশাসনের সহায়তায় বিভিন্ন ন্যাশন বিইল্ডিং এক্টিভিটিস ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টসহ নানাবিধ কাজ করে থাকে। কোন কোন সময় প্রয়োজন হলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ অভিযানও আমরা পরিচালনা করে থাকি। জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষায় আমরা শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে থাকি। এছাড়া কুয়েত, সৌদি আরব, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশে যখন প্রয়োজন হচ্ছে ওভারসিজ ডিউটিতে যাচ্ছি আমরা।’

নিজেদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সুসংহত ও মর্যাদাপূর্ণ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখারও দৃঢ় অঙ্গীকার করেন এই চারতারকা জেনারেল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও মূল্যবোধের মধ্য দিয়েই এই অগ্রযাত্রা নিশ্চিত হবে বলেও জানান সেনাপ্রধান।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমার লক্ষ্য আমি বলে দিয়েছি। আমি কোথায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেখতে চাই সেটা আমি পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছি। আশা করছি, আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সবাই একসঙ্গে কাজ করলে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারবো যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হবে জাতির গর্ব।’

আইএসপিআর জানায়, অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য এবং তাঁদের নিকটাত্মীয়ের সাথে কুশলাদি বিনিময় ও শুভেচ্ছা উপহার প্রদান করেন। পরে তিনি শান্তিকালীন পদকপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

এই অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্য, তাঁদের নিকটাত্মীয়, ঊধ্বর্তন সামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির গর্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছরই সেনাবাহিনী সদর দপ্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

কালের আলো/এমএএএমকে