‘বাকস্বাধীনতা’ মানে কি মিথ্যে বলার একান্ত অধিকার?
প্রকাশিতঃ 10:14 am | January 03, 2023
নিঝুম মজুমদার :
নাটক শেষ ১০ ডিসেম্বর। পুনরায় ২৪ তারিখের কথিত ডিসেম্বর ‘বিক্ষোভ’ গিলে খেয়েছে বিপ্লবীরা। গোলাপবাগের পরাজিত এন্টাগোনিস্টরা রাজপথ মাড়িয়ে নতুন ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য লিখছেন। আমেরিকান লবিস্টদের ফর্দ দেওয়া হয়েছে। তারা এখন কেবল টাকার অঙ্ক লিখে খেলোয়াড়দের হাতে দেবেন। খেলোয়াড়বৃন্দ প্রযোজকদের হাতে রসিদ ধরিয়ে দেবেন। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের ‘হোমগ্রোন’ ধনাঢ্য বিরোধী ‘ডায়াসপোরাগণ’ অর্থের সংস্থান করবেন রসিদের চাহিদা মতো। এগুলো চেনা গল্প।
আগামী ১২ মাস ধরে, অর্থাৎ আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই কাণ্ডগুলো চক্র করে চলতে থাকবে। তাদের লক্ষ্য থাকবে ‘মানবাধিকার নেই’, ‘বাকস্বাধীনতা নেই’, ‘মিছিল কিংবা মিটিংয়ের স্বাধীনতা নেই’ ঘরানার অনুযোগ।
ওপরে যা বলা হচ্ছে সেগুলো আন্তর্জাতিক ‘চাপ’। এগুলো থাকবে পদার্থবিজ্ঞানের চেনা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই। এগুলো রাজনৈতিক পদার্থবিজ্ঞান। ফলে তা চলবে এবং এসব পেরিয়েই টিকে থাকতে হবে। কিন্তু সমস্যার স্থান আসলে আন্তর্জাতিক চাপ নিয়ে নয়। যে চাপ অনুভূত হচ্ছে সেটি হচ্ছে বাকস্বাধীনতার নাম দিয়ে মিথ্যের ভয়াবহ চর্চাকে নিয়ে। মনে হচ্ছে এই দেশটি যেন চলছে মিথ্যের আর গুজবের ওপর। ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার জন্য মিথ্যের এই চর্চার ধারাগুলো গত প্রায় দুটি বছর ধরে যেভাবে চলছে সেটি এত বিস্ময়কর যে বিস্মিত হওয়ার ফলে যে অভিব্যক্তি সাধারণত দেওয়া হতো সেটি পরিবর্তন করে এখন নতুন অভিব্যক্তি খুঁজতে হচ্ছে।
উদাহরণ দেওয়া যাক-
১০ ডিসেম্বরের ঠিক কয়েক দিন আগে গণ-অধিকার পরিষদ নামের একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নেতা ডাকসু’র সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ফেসবুকে একটি ভিডিওর মাধ্যমে দাবি করেছিলেন যে বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে (কোনও এয়ারপোর্টের নাম বলেননি) দুটো প্লেন অপেক্ষমাণ রয়েছে। সরকার প্রধান তার ২৭ জন প্রতিনিধিসহ অর্থ-কড়ি, সম্পদসহ পালিয়ে যাবেন। আমি নিচে নুরের বক্তব্যের পুরোটাই পাঠকদের বুঝবার সুবিধার্থে কোট করছি-
‘সরকার কিন্তু যে কোনো সময় ঐ শ্রীলংকার মতন ওই সরকার প্রধান তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা, তাঁরা কিন্তু উড়াল দিবে প্লেন নিয়ে, যদিও ওবায়দুল কাদের সাহেব বারবার বলেছেন, আওয়ামী লীগ পালায় না। আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাবার দল না। কিন্তু আমাদের কাছে যে তথ্য আছে দুটো প্লেন রেডি করা আছে এবং সেই প্লেনে লাগেজ ভর্তি, ব্রিফকেইস ভর্তি কাপড়চোপড় টাকা পয়সা সব আছে। যে কোনো সময় ২৭ জনের প্রতিনিধি টিমসহ সেই সমস্ত প্লেন কিন্তু আকাশে উড়াল দিতে পারে।’
কিন্তু ১০ ডিসেম্বরের ব্যর্থ ‘বিপ্লবে’ সরকারের পতন না হলেও বিএনপির ৭ জন সংসদ সদস্যের পতন হয়েছে এবং বলা যেতে পারে অনেকটা মাথা ঝুঁকেই তারা পরাজয় মেনে ঘরে চলে গেছে। কিন্তু এই ঘটনার পর গত ১৩ ডিসেম্বর নুর তাঁর ফেসবুকেই একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন। নুরের বলা রাষ্ট্রপ্রধানসহ ২৭ জন প্রতিনিধি, দুটো পার্ক করা প্লেন, অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কি হলো সেই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিএনপির প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন-
‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে প্রশাসন, অমুক তমুক এই আন্দোলনের পক্ষে আছে, আমরা জয়লাভ করতে যাচ্ছি, হেলিকপ্টারো রেডি আছে, এরকম পরিস্থিতি তৈরি হইলে তারা দেশ ছাড়বে, আমরা এসমস্ত কথা বলেছি মানুষকে উত্তেজিত করার জন্য, মানুষকে আপনার আগ্রহী করার জন্য, মানুষকে সাহসী করার জন্য, মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য, আগ্রহী করার জন্য।’
তার মানে কী দাঁড়ালো? নুরুল হক নুর জনগণকে উত্তেজিত করবার জন্য মিথ্যে বলেছে? মানি লন্ডারিং-এর মতো অভিযোগ, দেশের অর্থ পাচার করার মতো অভিযোগ, দেশের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার সমস্ত অভিযোগই তাহলে মিথ্যে আর জনতার সঙ্গে প্রতারণা? তাহলে সাধারণ জনতা যারা এসব কথা সত্য মনে করে বিশ্বাস করেছিল এবং মানি লন্ডারিং রুখবার জন্য যারা এয়ারপোর্টে কষ্ট করে জমায়েত হয়েছিল, যারা দুটো প্লেন রুখবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাই ছিল তামাশা? মিথ্যে?
নুরের এই মিথ্যে বলবার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ভেতর সামান্য অনুশোচনা দূরের কথা বরং বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই তিনি এর পুরো দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা আমাদের সামনে এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে নুর যেন বিএনপির পাঠানো স্ক্রিপ্ট এবং আশ্বাসে গুজব রটিয়েছিলেন এবং ১০ তারিখের বিপ্লবের এহেন ব্যর্থতার পর সেটি বিএনপির দায় বলে সমস্ত রাগ আর ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। তাহলে কি নুর বিএনপির ‘বি-টিম’ হিসেবেই রাজনীতি করছেন?
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে নুরুল হক নুর বলছেন,
‘বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করার জন্য তারা (সরকারি দল) গুজব ছড়ায়, প্রোপাগান্ডা ছড়ায়’ এই ছাড়াও সাবেক এই ভিপি তাঁর অসংখ্য বক্তব্যে বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই বলে বারবার অভিযোগ করেছেন। ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর নুর তার দলের আত্মপ্রকাশ মুহূর্তে তার দলীয় যে দফাগুলোর বর্ণনা করেছিলেন সেখানের সপ্তম দফায় পরিষ্কার করে বলেন যে
‘সপ্তম দফা- গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- বাক, ব্যক্তি, চিন্তা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত সাংবাদিকতার সুরক্ষায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের মতো সব দমন ও নিপীড়নমূলক গণবিরোধী আইন বাতিল করা’।
আমি এই নুরের বাকস্বাধীনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরই বলা আরেকটি বক্তব্যকে এখানে উদ্ধৃত করতে চাইছি। ১ মার্চ ২০২১ইং তারিখে বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদের বরাতে, পরবর্তীতে একই বক্তব্যের ভিডিও থেকে জানা যায়, নুরুল হক নুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন এই বলে যে-
‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজকে পুলিশের গাড়ি রয়েছে। আমি আমার ছাত্র ভাই-বন্ধুদের বলবো, পরবর্তীতে যদি পুলিশের গাড়ি এইখানে থাকে আগুন ধরিয়ে দিবেন। আগুন ধরিয়ে গাড়ি পুড়লে হুকুমের আসামি আমাকে, বলবেন যে ডাকসুর ভিপি নুর বলেছে, আমরা নুরের কথার ওপর আগুন দিয়েছি।’
ওপরের উদ্ধৃতিগুলোর যদি একটা সারমর্ম আমরা দাঁড় করাই তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একজন ব্যক্তি তার অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হয়ে (১) ক্রমাগতভাবে গুজব রটাচ্ছেন; (২) গুজব রটাবার পর সেটিকে জনতাকে উসকে দেবার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন এবং নিজের বলা মিথ্যে গর্ব নিয়ে নিজের ফেসবুকে বসে বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই তা ছড়াচ্ছেন; (৩) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাসে আগুন ধরিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে গর্বভরে বলছেন এই নির্দেশ যেন তার নেতাকর্মী পালন করেন এবং এবং এটি তার নির্দেশে হয়েছে এই কথা যেন আগুন লাগাবার পর তা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়; (৪) সরকার গুজব রটাচ্ছে ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে বলে দাবি করছেন; (৫) বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই বলে ক্রমাগত ভাষণে বলছেন।
ওপরে আমার নিজের লেখা সারাংশ পড়ে আমি নিজেই আসলে হতবাক হয়ে গেছি। তাহলে বাকস্বাধীনতা আর গুজব নিয়ে জানা যে ন্যারেটিভ সেটিই কি আমাদের নতুন করে জানতে হবে? বাংলাদেশে কি আইন আর আদালত মৃত? একটি মানুষ ক্রমাগত মিথ্যে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, নৈরাজ্য করবার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে বীরদর্পে দেশে রাজনীতি করে বেড়াচ্ছে, আজ আমেরিকা দূতাবাস কাল যুক্তরাজ্য দূতাবাসে দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছে অথচ তাঁকে একটিবারের জন্য এসব নৈরাজ্য ও মিথ্যে গুজবের দায়ে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না, এটি একদিকে যেমন হতাশার অন্যদিকে বিস্ময়ের।
তাহলে আমাদের দেশের বিরোধী রাজনৈতিক মতগুলো ঠিক কি ধরনের বাকস্বাধীনতার দাবি করছেন বা করে এসেছেন এতদিন? মিথ্যে আর গুজব রটাবার স্বাধীনতা চাইছেন তারা? তবে কি বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা আমাদের এতদিনের পরিচিত ব্যাখ্যার বাইরের কোনও অলীক বিষয়? যা আমরা কখনও আসলে বুঝতেই পারিনি? বাকস্বাধীনতা বলতে কি সরকারবিরোধী বিরুদ্ধ মতেরা জনতাকে বিভ্রান্ত করবার, মিথ্যে বলে ভুল পথে নেবার কিংবা নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত করবার বাকস্বাধীনতা চাইছেন?
যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশের আইনের প্রয়োগ এই সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কোথায়? সরকারই বা কেন এমন অসহ্য সহনশীল আচরণ করছে? নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে আইনের প্রয়োগ বলতে যে প্রক্রিয়া, পদ্ধতি বুঝি সেটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আকার ধারণ করেছে এখানে?
শুধু আইনের প্রয়োগ বলেই বা আমরা ক্ষান্ত হচ্ছি কেন? সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ, দেশের অর্থপাচারের অভিযোগ কিংবা পার্ক করে রাখা উড়োজাহাজ নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে লাগেজ নিয়ে পালিয়ে যাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কি সামান্য তদন্তেরও প্রয়োজন মনে করছেন না প্রশাসন? একটি বারের জন্যও কি মনে হচ্ছে না আমাদের এই বাকস্বাধীনতা আর আইন-আদালত নিয়ে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের বিষয়টুকু মাথায় রেখেও এই ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখা আদৌ প্রয়োজন?
আমরা কি তাহলে এই অদ্ভুত ‘বাকস্বাধীনতার’ উদাহরণ নিশ্চিত করতে চাইছি আগামী প্রজন্মের কাছে, যেখানে বিরোধী দলের বাকস্বাধীনতা মানে ক্রমাগত মিথ্যা ও গুজব রটাবার স্বাধীনতা?
নাকি এই জনপদে ইচ্ছেমতো মিথ্যে বলা, গুজব রটানো, নৈরাজ্যের প্রকাশ্য নির্দেশের পরেও এখানে বাকস্বাধীনতার গোলা ঠিক পূর্ণ হয়ে ওঠে না? নাকি এই দেশে বাকস্বাধীনতার পূর্ণরূপ কেবল মিথ্যে বলবার একান্ত অধিকারের মধ্যেই ভাস্বর হয়ে ওঠে?
লেখক: ব্যারিস্টার অ্যান্ড সলিসিটর