উন্নত পরিবহন ব্যবস্থায়ই স্মার্ট দেশ
প্রকাশিতঃ 11:16 am | January 19, 2023
ড. মতিউর রহমান:
প্রতিদিনই দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের কান্না এবং পরিবারের স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি দেখে যে কেউই মর্মাহত হন, যন্ত্রণাবোধ করেন এবং কেউ কেউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে যানবাহনের চালক, পরিবহন কর্মী ও সাধারণ যাত্রীরা। বাদ যাচ্ছে না সাধারণ পথচারীরাও। রাস্তায় চলতে গিয়ে অনেক নিরীহ পথচারীও দুর্ঘটনার শিকার হন। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যু মিছিল থামার কোনো লক্ষণ নেই বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন মারা যায়। সেই হিসাবে বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২২ সালে বাংলাদেশে সড়ক, রেলপথ এবং নৌপথে ৭,৬১৭ টি দুর্ঘটনায় মোট ১০,৮৫৮ জন নিহত এবং ১২,৮৭৫ জন আহত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬,৭৪৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯,৯৫১ জন নিহত এবং ১২,৩৫৬ জন আহত হয়েছেন, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। ২০২১ সালের তুলনায়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ২৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
এছাড়া ওই বছরে (২০২২) ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত ও ২০১ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২৬২টি নৌ দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন মারা গেছে, ৩১৮ জন আহত হয়েছে এবং আরো ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছে। তবে, প্রকৃত দুর্ঘটনার সংখ্যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে আরো চার বা পাঁচ গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে ৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় ৩৮.২০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে পথচারীদের অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে। তবে সড়কে পথচারীদের মৃত্যুর পেছনে আরও অনেক কারণের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সড়কে নিহত পথচারীদের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি মহাসড়কে। দুর্ঘটনায় পথচারীদের মৃত্যুর দিক থেকে এরপরেই রয়েছে আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং তারপরেই গ্রামীণ সড়কের অবস্থান।
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোর অনিয়ম, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন ও সুপারিশ প্রণয়নের চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়েও প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহন কৌশল প্রণয়ন।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণগুলো হল; বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, জরাজীর্ণ রাস্তা, ফিটনেস বিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার এবং রাস্তা ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।
এছাড়াও বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা চিহ্নিত কারণগুলি হল চালকের অসতর্কতা এবং লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার সংকীর্ণতা, মহাসড়কে কম গতির যানবাহন, প্রতিযোগিতামূলক ড্রাইভিং এবং ওভারটেকিং, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন।
সড়কের মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার, ওভারব্রিজের অভাব, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, হকারদের ফুটপাথ দখল, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়কে অবৈধ স্টল ও স্থাপনা, ব্যাপক সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, পণ্য ও যাত্রীদের অতিরিক্ত বোঝা, সড়ক বন্ধ করে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, গণপরিবহন ধর্মঘট, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব ইত্যাদি।
বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও এ খাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের গতি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু গণপরিবহন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের গতি কমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা তার চাক্ষুষ প্রমাণ। যানজটের কারণে রাজধানী শহর ঢাকা যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে তা কোনো সভ্য ও উন্নত দেশে হয় বলে জানা নেই।
ঢাকার নৈরাজ্যিক গণপরিবহন ব্যবস্থা কীভাবে আর্থিক ক্ষতি, স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে অনেক পরামর্শ ও বাস্তবায়ন কৌশল দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাতে কাজ হয় বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি যা তাই রয়েছে এবং দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। সুতরাং আমরা যে গতিতে এগোতে চাচ্ছি তা থমকে গেছে গণপরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার কারণে।
সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে বিশেষজ্ঞরা যে খাতটিকে বারবার গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটি হচ্ছে গণপরিবহন খাত। কারণ তারা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলোর জন্য উপযোগী গণপরিবহন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখছে না। পরিবর্তে, দেশের গণপরিবহন খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, যা একটি উন্নত দেশে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা রোধে রাজধানীসহ সড়ক-মহাসড়কে গণপরিবহনের নৈরাজ্য কমাতে হবে। গণপরিবহনের নৈরাজ্য কমাতে যথাযথ পরিকল্পনা ও আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি না হওয়ায় গণপরিবহন খাতে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম কারণ নান প্রকার ছোট যানবাহন। এসবের মধ্যে একটি হল মোটরসাইকেল। এসব যানবাহন রাস্তায় বিপদ সৃষ্টি করছে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন । এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল- অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন না চালানো, মাদক সেবন করে যানবাহন না চালানো, দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক ও মহাসড়কে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে বাজার ও দোকানপাট অপসারণ, শহরের ফুটপাত, রাস্তা-ঘাট, ইত্যাদি দখলমুক্ত করা।
সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের টহল জোরদারকরণ ও ক্যামেরা স্থাপন, দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহন ও ব্যক্তিদেরকে দ্রুত উদ্ধারের জন্য ও তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে মহাসড়কের পাশে হাসপাতাল স্থাপন, হরেক রকম যানবাহনের পরিবর্তে চার থেকে পাঁচটি যানবাহন প্রচলন এবং বাকিগুলো নিষিদ্ধকরণ। যাত্রী, গণপরিবহন চালক ও শ্রমিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান।
গণপরিবহনের চালক, হেলপার, যাত্রী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে সব যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তায় এর কোনো বিকল্প নেই। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত দেশ ও সভ্যতার প্রতীক। বাংলাদেশকে উন্নত স্মার্ট দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে গণপরিবহনে নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।