খাদ্যাভ্যাস বদলাতে এবারের রমজান এক বড় সুযোগ
প্রকাশিতঃ 10:41 am | February 09, 2023
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :
রোজা এলেই সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ে– এটা বাংলাদেশের বহু দিনের বাজার সংস্কৃতি। কিন্তু এবার যে পণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা ভাবতেও ভয় হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বলে দিয়েছে, ডলারের চড়া দামের কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি থাকবে। তবে সরকারের আরেকটি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, রোজার এক মাস ১৭ দিন আগেই গত বছরের তুলনায় আমদানি করা পণ্যের দাম গড়ে ৫৯ শতাংশ বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিতে এলসি জটিলতা দূর করা না গেলে রমজানে পণ্যের দাম আরও বাড়বে।
বুঝতে বাকি নেই, এবারের রমজান স্বাভাবিক থাকছে না, পণ্যের জোগান আর দাম, দুই ক্ষেত্রেই বড় সমস্যা হবে।
বাজারে এমনিতেই আগুন। রোজায় আগুনের আঁচ বেশি করে যে লাগবে সেটা নিশ্চিত। দুর্দিনে সংসারের সবার মুখে খাবার জোগানোর লড়াই করা দরিদ্র ও নির্দিষ্ট আয়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে এবার দ্রব্যমূল্যের ঝড় সামলাবেন তা ভাবা যাচ্ছে না। অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এরমধ্যেই বলে ফেলেছেন, এবার রমজান মাসে পণ্যের দাম নাগালের বাইরে যাবে না। মন্ত্রীদের হয়তো এমন কথা বলতে হয়। দামের কোন স্তরটা যে নাগাল সেটাই মানুষ বুঝতে পারে না কোনোদিন।
তবে মন্ত্রী একটা কথা যৌক্তিক বলেছেন, ডলারের কারণে আগামীতে দামের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। আর ভোক্তারা একসঙ্গে পুরো রমজান মাসের পণ্য কিনলে বাজারে এর একটা প্রভাব পড়ে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তখন এই সুবিধা নিয়ে থাকে।
তবে কি আমরা বাস্তবতার নিরিখে, এবারের রমজানে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনবো কিছুটা? ইতোমধ্যে চিনির বাজার অস্থির, তেলের দাম বাড়বে যে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সময় মতো এলসি খুলতে না পারায় ছোলা, খেজুর আমদানিতে বিলম্ব হয়েছে। ছোলা আমদানির জন্য নিকটবর্তী মিয়ানমার ও ভারতে উৎস খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা।
এমনিতে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলে থাকেন, সঠিক খাবার তালিকা অনুসরণ করে রোজা রাখা উচিত। কিন্তু তা থেকে আমরা বরাবরই দূরে থাকি। রোজায় ইফতার মানেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় আয়োজন। ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডাল ও সবজি বড়া, আলুর চাপ, খেজুর, হালিম, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রঙমিশ্রিত বাহারি শরবত। এছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারি তো আছেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথ্যমতে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। আর রমজানে তৈরি হয় অতিরিক্ত আরও তিন লাখ টনের চাহিদা। এরমধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ২ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ২০ লাখ টন। দেশে চিনির চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ টন। রমজানে এর চাহিদাও বাড়ে ৩ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় ৩০ হাজার টন। আমদানি করতে হয় ২০-২২ লাখ টন। মসুর ডালের চাহিদা ৬ লাখ টন। রমজানে চাহিদা বাড়ে ১ লাখ টনের। দেশে উৎপাদিত হয় ২.২ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ৪ লাখ টন। দেশে পিঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। রমজানে চাহিদা ৪ লাখ টন।
এরকম প্রতিটি পণ্যেরই অতিরিক্ত চাহিদা থাকে রমজানে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে এবার আমাদের সামনে এক নতুন পৃথিবী। কোভিডের আক্রমণ ঝিমিয়ে না আসতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা সারা পৃথিবীর বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। উন্নত দেশগুলো থেকেও খবর আসছে যে জিনিসপত্রের দাম এবং সরবরাহে বড় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই খাবার রেশনিং করছেন। বাংলাদেশে কয়েক দফায় সব প্রকার জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে, সামগ্রিকভাবে যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে সরকারের জন্য। রমজাননির্ভর পণ্য যেমন, চিনি, ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, খেজুর, আদা ও রসুনের দাম তিন মাস আগেই বেড়েছে। রমজান সামনে রেখে এসব পণ্য ভয় ধরাচ্ছে সবাইকে। আরেক পণ্য পিঁয়াজের বাজার তো কয়েক মাস ধরেই চড়া।
একদিকে দাম বেশি, অন্যদিকে রমজানে অপচয় হয় প্রচুর। অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব আমাদের তেমন একটা ভাবায় বলে মনে হয় না। এবারে অন্তত আমাদের নতুন চিন্তা আসা উচিত। খাদ্য নির্বাচন থেকে তার ব্যবহার পর্যন্ত ভেবে দেখা উচিত আমরা এই রমজানে কতটা বিলাসিতা করবো বা করবো না। খেজুর, ছোলা, পিঁয়াজু বা বেগুনি খেতেই হবে- এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল দিয়ে ইফতারি করা যায় কিনা, চিনি ও তেলের খরচ কীভাবে কমিয়ে রোজা রাখা যায়, সেই চিন্তা আসুক। কমে আসুক ইফতার মাহফিলও।
খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলার জন্য এবারের রমজানকে একটি বড় সুযোগ হিসেবেই নেওয়া যায়। যদি শারীরিক দিকটাও বিবেচনা করা হয়, তাহলেও ভাজাপোড়া, তেল-চর্বি ছাড়ার মধ্যেই আছে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। অতিরিক্ত ওজন কমানো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখা, ডায়াবেটিস কিংবা হৃদযন্ত্রের নানা রোগ কমিয়ে দেওয়া, কিডনির সমস্যার দেখভাল, হজমে সাহায্য করা – এরকম হাজারো সুবিধা নিশ্চিত করতে এই রমজানেই হোক আমাদের নতুন শুরু।
লেখক: সাংবাদিক