চির প্রেরণার অমর একুশে
প্রকাশিতঃ 12:01 am | February 21, 2023

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
গভীর অনুভব আর বেদনার বলেই কীনা প্রয়াত আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। আত্মত্যাগের অহংকারে জ্বলে ওঠার অনন্য এক দিন আজ। আগুনঝরা ফাল্গুনে রক্তে নাচনতোলা আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যের দিন। নিকষ কালো অন্ধকার রাতের পর পূবের আকাশে আজ উঁকি দিবে যে সূর্য, তা যেন আজ রক্তিম ভাষা শহীদদেরই রক্তে। ফাল্গুনের রক্তরঙের পলাশ প্রতীক মহিমা এই দিনের। বাঙালির জাতির অনন্য গৌরব আর চেতনার লাল মশাল জ্বালানোর চির প্রেরণার দিন আজ।
আজ সকালে গাছে গাছে ফুটবে যে ফুল, ছড়াবে যে সৌরভ, হাট-মাঠে উচ্চারণ হবে যে ভাষা, তা আমাদের মায়ের মুখের মধুর উচ্চারণ বাংলা। আকাশে রঙিন ডানা মেলে পাখি গাইবে তার গান। উড়বে ঘুড়ি, নাচবে শিশু, সখি বললে কত কথা। একুশে ফেব্রুয়ারী মায়ের মধুর ভাষা বাংলায় দিনমান হৈচৈ-গল্পগুজবের দিন। মধুর বসনে মধুর ডাকে মধুর প্রেমে আলিঙ্গনের দিন। কখনোবা হারানো স্বজনের জন্য বুকের ভেতর গুমরে কেঁদে ওঠার দিন আজ। অশ্রুতে সিক্ত হবে শহীদ মিনারের প্রতিটি ফুল। পরাধীনতার বিষবাস্প থেকে সেই মধুর ভাষা বাংলাকে বাঙালির নিজের করে পাওয়ার দিন আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। আমাদের পরম গৌরবের দিন।
স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসে আঁকা কালজয়ী সেব উপাখ্যানের প্রথম উৎসমুখ খুলে যাওয়ার দিন আজ। বাহান্নর এই দিনে ভয়কে তুচ্ছ করে মায়ের ভাষা বাংলার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন যেসব সাহসী সন্তান, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানোর দিন। বাঙালির আত্নদানের মধ্য দিয়ে এ দিনেই প্রথম প্রতিষ্ঠা পায় বাঙালির আত্মপরিচয়ের অধিকার।
একুশের সব শহীদ এ মাটির গর্বিত সন্তান। আজ সমগ্র বাঙালি জাতি কালজয়ী অমর সঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’Ñ সুর মূর্ছনায় প্রাণমন উজাড় করে গোটা বিশ্বকে জানান দেবে বীর সন্তানদের বীরত্বগাঁথার ইতিহাস। ফাগুনের আগুনঝরা এই দিনে সেই কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙানো রাজপথে মায়ের মুখের ভাষার জন্য অকাতরে যারা জীবন দিয়েছিলেন, তাদের প্রেরণায় ও স্মরণে জাতি উদ্দীপ্তগতিতে এগিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
দেশবরেণ্য রাজনীতিক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন-‘প্রকৃতপক্ষে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।
সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।’ (পৃষ্ঠা-৯১, ৯২)। ’৪৮-এর ১১ মার্চ অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে। সেদিন যারা মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে সংগ্রাম করে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব শামসুল হক ছিলেন তাদের অন্যতম। মার্চের ১১ থেকে ১৫ এই পাঁচদিন কারারুদ্ধ ছিলেন নেতৃবৃন্দ। পাঁচদিনের কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’- নানা ধরনের স্লোগান।
এ সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না। হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব’।” (পৃষ্ঠা-৯৩, ৯৪)। বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্য আত্মপ্রত্যয় ছিল! তখন কে জানত যে, ’৪৮-এর এই ১১ মার্চের পথ ধরেই ’৫২, ’৬৯ এবং ’৭১-এর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে! কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানতেন! কারণ তিনি দূরদর্শী নেতা ছিলেন, লক্ষ্য স্থির করে কর্মসূচি নির্ধারণ করতেন। যেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়, সেদিনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি; একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। আর তাই ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য।’
সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ কত নাম না জানা অকুতোভয় বীর বাঙালি মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য আত্নোৎসর্গ করে শোকবহ অমলিন যে রক্ত সিঁড়ি তৈরি করে গেছেনÑ তারই পথ বেয়ে এসেছে মহান স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির অসীম শোক ও বেদনাময় এবং গর্বিত উজ্জীবন এই একুশে আজ শুধু বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র বিশ্ব আজ গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে পালন করছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
তীব্র বেদনা ও আত্নত্যাগের অহংকারের সঙ্গে ভাষার গৌরব সুপ্রতিষ্ঠিত করার অনন্য দিনটিতে আমরা শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা সব শহীদকে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ইতিহাসের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগই হোক একুশের দৃপ্ত অঙ্গীকার। আসুন, সবক্ষেত্রে মায়ের ভাষার সম্মান ও মর্যাদা ধরে রেখেই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে এই দেশকে সন্ত্রাস, জঙ্গি, মাদক ও যুদ্ধাপরাধীমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলতে আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করি। অবিরাম ভালোবাসা সবার জন্য।
কালের আলো/ডিএস/এমএম