বৈপ্লবিক পরিবর্তন কৃষিতে, হারভেস্টারে ধান কাটায় সাশ্রয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা
প্রকাশিতঃ 8:43 pm | March 05, 2023
এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
সুনামগঞ্জের কৃষক মো.আবুল বারাকাত। কৃষিই তাঁর প্রধান জীবিকা। কিন্তু শ্রমিক সঙ্কটে প্রতি বছর বন্যায় অনেক ধান নষ্ট হতো তাঁর। আবার হাতের নাগালে শ্রমিক মিললেও মজুরি বেশি। এমন দ্বিমুখী সঙ্কটে তাঁর ভুবনে আশার আলো হয়ে এসেছে একটি কম্বাইন হারভেস্টার। প্রায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে তিনি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প থেকে কিনেছেন ইয়ানমার এজি ৬০০ মডেলের একটি কম্বাইন হারভেস্টার। অনেকটাই ট্রাক্টরের মতো মতো দেখতে এই যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা থেকে শুরু করে মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আস্ত থাকে খড়ও। আমন ও বোরো মৌসুমে সব খরচাপাতি বাদ দিয়ে কৃষিতে আধুনিক এই যন্ত্রের মাধ্যমে ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয় করছেন এই কৃষক।
শ্রমিকের পাশাপাশি খরচও সাশ্রয় হওয়ায় হাসি ফুটেছে আবুল বারাকাতের মুখে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শিক্ষিত এই কৃষক বলেন, ‘মাঠে সোনালী ফসলে আমরা যতটা না খুশি তাঁর চেয়ে বেশি চিন্তাগ্রস্ত হতে হয় কীভাবে এই ফসল ঘরে তুলবো সেটি নিয়ে। যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে কৃষিবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টারের বন্দোবস্ত করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তারা ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে আমাদের মতো কৃষকদের এটি সরবরাহ করেছেন। এতে কৃষকরা দ্বিগুণ উদ্যমে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। কৃষিতে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনও সম্ভব হচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম’র দেওয়া তথ্য মতে, ‘জেলায় রোপা আমন মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টারে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের ফলে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৩৪ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা।’ তবে শুধু আবুল বারাকাতই নন দেশের হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে ৭০ শতাংশ এবং সমতলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষককে কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় কৃষিতে খরচ কমিয়ে আনার মাধ্যমে কৃষককে লাভবান করতে কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এই আধুনিক যন্ত্র। সুফলও মিলছে হাতেনাতে। আমন মৌসুমে দেশজুড়ে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের ফলে কৃষকের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১৯ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা।
জানতে চাইলে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ তারিক মাহমুদুল ইসলাম কালের আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকের পরিবর্তে কম্বাইন হারভেস্টারের মতো আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার সাশ্রয়ী ও ঝামেলামুক্ত কৃষি উপহার দিচ্ছে দেশের মাঠের আসল নায়ক কৃষকদের। পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ ক্যাটাগরির যন্ত্র হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষককের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষিতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার কৃষিতে আধুনিকায়নে জোর দিয়েছে। এজন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষককে কম্বাইন হারভেস্টারের পাশাপাশি রিপার ও রিপার বাইন্ডার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার বা বেড প্লান্টার, পাওয়ার প্রেসার নেইজ শেলার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পাওয়ার উইডার, ড্রায়ার, পটেটো ডিগার ও পটেটো চিপস বানানোর যন্ত্র দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের আওতায় ভর্তুকির মাধ্যমে মোট ২৫ হাজার ১৬৫ টি কৃষি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টারের সংখ্যা ৭ হাজার ২৫৬টি। এসব কৃষি যন্ত্র প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে কৃষকের জীবনপ্রবাহ। কৃষিতেও এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাসান ওয়ারিসুল কবির জানান, ভোলায় রোপা আমন মৌসমে কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটার ফলে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। কিশোরগঞ্জে এই সাশ্রয়ের পরিমাণ আরও বেশি। কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুস সাত্তার জানান, ‘যন্ত্রটি শ্রমিক ও খরচের সর্বোচ্চ সাশ্রয় করছে। এখানে মোট সাশ্রয়ের পরিমাণ ৯৪ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা। একই রকম তথ্য জানান শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুকল্প দাস। তিনি বলেন, ‘দেশে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শেরপুর জেলায় রোপা আমন মৌসমে কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটায় সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা।’
‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ তারিক মাহমুদুল ইসলাম জানান, দেশে ৫৭ লক্ষ ৩০ হাজার ৭৬৪ দশমিক ২ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কাটা জমির পরিমাণ ৬ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৭০ দশমিক ৫১ হেক্টর। যা মোট আবাদকৃত জমির ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটার ফলে কৃষকের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৫৪৯ কোটি ২১ লক্ষ টাকা। কম্বাইন হারভেস্টার রোধ করেছে প্রায় ২ লক্ষ ১৮ হাজার টন শস্যের অপচয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫৭০ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। এ দু’টি বিষয় যুক্ত করলে রোপা আমন মৌসুমে দেশে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষকের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১৯ কোটি ৪১ লক্ষ টাকা।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথাগতভাবে শ্রমিকের মাধ্যমে এক একর জমির ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দি করতে প্রায় ১১ হাজার ৮০০ টাকা খরচা হয়। অথচ কম্বাইন হারভেস্টারে সমপরিমাণ জমিতে সাকুল্যে খরচ মাত্র ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ এর মাধ্যমে প্রতি একর জমিতে কৃষকের লাভ হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকা। শুধু তাই নয় কম্বাইন হারভেস্টারে ফসল কাটা পরবর্তী অপচয় ২ থেকে ৩ শতাংশ, যেটি সনাতন পদ্ধতিতে ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। এতে করে কৃষকের ভরসার আরেক নাম হয়ে উঠেছে কম্বাইন হারভেস্টার।
কালের আলো/এমএএএমকে