আদর্শ শিক্ষকের গুনাবলি
প্রকাশিতঃ 10:42 am | January 13, 2023
সুলতানা রাজিয়া :
অজানাকে জানা, অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোতে উত্তরণ, নামসর্বস্ব মানুষ নামের জীবকে পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণের উপযোগী করে গড়া এ মহৎ কাজ যিনি বা যারা সম্পাদন করেন তারাই শিক্ষক। শিক্ষক পৃথিবীর বুকে এমন এক শ্রেণি বা গোষ্ঠী যাদের মাথার চুল থেকে আরম্ভ করে পোশাক পরিচ্ছদ , কথাবার্তা,চলাফেরা,আচার ব্যবহার ইত্যাদি সব শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষণীয়। এ জন্য শিক্ষকরা হয়ে থাকেন অত্যন্ত সচেতন আদর্শের মূর্ত প্রতীক। শিক্ষক, শিক্ষার্থী,প্রশাসন ও উপযুক্ত পরিবেশ এ চারটির সমন্বয়ে শিক্ষাকার্যক্রম সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। শিক্ষক তথা যে কোন ব্যক্তি তার পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দ্বারা প্রভাবিত হন। তাই এ ক্ষেত্রে সকলেরই সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। একজন আদর্শ শিক্ষকের এমন কিছু গুনাবলি থাকে যা তার শিক্ষার্থীর নিকট গ্রহণযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং তার পেশাগত দায়িত্বপালনে সহায়তা করে।
একজন আদর্শ শিক্ষক তার আদর্শের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন। যে শিক্ষায় আদর্শ ও নৈতিকতা নেই, সেটা মূলত কুশিক্ষা। একজন শিক্ষক আদর্শিক জ্ঞানে সুষমামণ্ডিত হবেন, নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন ও অন্যান্য জীবন সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন। শিক্ষকতাকে নিজের জীবনের আদর্শ পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং প্রতিটি পাঠ আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করে পড়াবেন। ইবাদতের উদ্দেশ্যে শিক্ষাদানে ব্রতী হবেন, দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণকে সামনে রেখে এ কাজে আত্মনিয়োগ করবেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে সৃষ্টিকর্তার অনুগত বান্দা হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষার্থীদের বাইরে যারা আছেন তাদের জন্যও তিনি হবেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। কথা ও কাজের মধ্যে তিনি মিল রাখবেন, অল্পে তুষ্ট থাকবেন ও অন্যকে অগ্রাধিকার প্রদান করবেন। তিনি কখনোই সম্পদকে প্রাধান্য দিবেন না।
তিনি যে বিষয়ে শিক্ষাদান করবেন, সে বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হবেন। তিনি সবসময় জ্ঞানচর্চা করবেন এবং সমসাময়িক বিষয়ে ধারণা রাখবেন যাতে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদান করতে পারেন। একজন আদর্শ শিক্ষক গবেষকের মন নিয়ে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করবেন, তার গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রদান প্রক্রিয়ার উন্মেষ ঘটবে। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ হবেন। উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করবেন, জানা বিষয় থেকে অজানা বিষয়ের দিকে যাবেন, শিক্ষার্থীর গ্রহণ করার সামর্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এবং নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ব্যক্তিত্ব মানুষকে সমাজ তথা সর্বক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য করে তোলে। একজন ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক তার ক্লাসকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন। একজন ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক শালীন, মার্জিত ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পোশাক পরিধান করবেন, আচার ব্যবহারে সংযত হবেন এবং রুক্ষ মেজাজ পরিহার করবেন। বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও সুন্দর প্রকাশ ভঙ্গির অধিকারী হবেন এবং নিয়মনীতির ক্ষেত্রে হবেন কঠোর। তিনি সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুষম দেহ ও সুস্থ মনের অধিকারী হবেন। একজন ভালো ও আদর্শ শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর প্রতি যথাযথ মমত্ববোধ, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পোষণ করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তার কর্তৃত্বও নেতৃত্ব মেনে নেয় । কথায় বলে , “শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে“। তিনি শিক্ষার্থীর সুবিধা অসুবিধার খবর রাখবেন এবং সমস্যা দূরীকরণ আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষার্থীর একান্ত আপনজন হয়ে তার পড়ালেখায় উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবেন , যা একজন শিক্ষার্থীর জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে । শাস্তি প্রদানে সতর্ক হবেন, অতিরিক্ত রাগ, কঠোরতা, ধমক, চেচামেচি ও বকাবকির মাধ্যমে কাজ আদায়ের পরিবর্তে শান্ত মনে তাদের সমস্যা বুঝে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে সমাধানের চেষ্টা করবেন। ইনসাফ ও নীতিবোধ সকল মানুষকে উন্নতি ও সম্মানের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। ন্যায়নীতিবোধ একজন শিক্ষককে তার শিক্ষার্থীর নিকট সম্মানিত ও প্রিয় করে তোলে। সুতরাং একজন আদর্শ ও ভালো শিক্ষক তার সকল শিক্ষার্থীকে সমান নজরে দেখবেন, পরীক্ষার খাতা ইনসাফের সাথে মূল্যায়ন করবেন , জাতির নির্মাতা হিসেবে সর্বোচ্চ চরিত্র, ন্যায়নীতিবোধ ও কর্মের অধিকারী হবেন। শিক্ষার্থীর সাথে আচার আচরণ ও ব্যবহারে ন্যায় ও সমতার প্রতি খেয়াল রাখবেন এবং সবাইকে সমান নজরে দেখতে সচেষ্ট হবেন।
একজন আদর্শ শিক্ষক তার পাঠদানকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করবেন। তিনি উদার, হাসিখুশি ও প্রফুল্ল মন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করবেন। সহজ সরলভাবে পাঠ উপস্থাপন করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই গ্রহণ করতে ও বুঝতে পারে এবং পাঠগ্রহণে আগ্রহী হয়। উপমা , উদাহরণ, প্রয়োজনীয় শিক্ষাসহায়ক উপকরণ ব্যবহার করবেন এবং প্রয়োজনীয় অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করবেন যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পড়ালেখাকে আনন্দ ও আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতে পারে। তিনি ভাষা ও শব্দ চয়নে সচেতন হবেন , শুদ্ধ ও বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করবেন এবং আঞ্চলিক ভাষা পরিহারে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। একজন ভালো ও আদর্শ শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানের প্রতি থাকবেন নিষ্ঠাবান, আন্তরিক ও প্রশাসনের সাথে থাকবে তার সুসম্পর্ক। তিনি প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি , আইনকানুন যথাযথভাবে মেনে চলবেন, প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ গ্রহণ করবেন এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে কোন পরামর্শ থাকলে তা নির্দিষ্ট ফোরামে উপস্থাপন করবেন। তিনি দলীয়করণ ও পরনিন্দা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন এবং তিনি হবেন একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ও সময়ানুবর্তী। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানকে একান্ত নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে যথাযথ ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের শিক্ষাপ্রদান ও যথাযথ দায়িত্ব পালন গড়ে তুলতে পারে আদর্শ জাতি, সুনাগরিক তথা আদর্শ ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র। আমাদের মনে রাখতে হবে, “ Education is the backbone of a nation” and “An ideal teacher is the backbone of education”.
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, হাজী মাদবর আলী হাচানিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ভাটারা, ঢাকা।