মানবতার প্রতি মমতাশীল হই

প্রকাশিতঃ 11:35 am | July 14, 2023

মাহমুদ আহমদ:

মসজিদের কাঁঠাল নিলাম নিয়ে বিরোধের জেরে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। অতি সামান্য বিষয় নিয়ে হতাহতের ঘটনার সংবাদ প্রতিদিন পাওয়া যায়। সামাজিক অবক্ষয় আজ চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কেউ কারো প্রতি মমতাশীল নই বলেই এমনসব মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিনিয়ত হচ্ছে।

মসজিদ শান্তির স্থান আর সেখানেই যদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে তাহলে আর বোঝার বাকি থাকে আমাদের অবস্থান কোথায়। অথচ ইসলাম এমন শান্তিপ্রিয় ধর্ম যার শিক্ষা হচ্ছে সমাজ দেশ সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যারা সমাজে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তাই আমাদের আদর্শও হওয়া চাই শ্রেষ্ঠ।

একে অপরের সাথে বিভিন্ন কারণে মতবিরোধ থাকতে পারে তাই বলে কারো ওপর আক্রমণ করে বসা বা তার ক্ষতির চিন্তা করা এটা মোটেও ধার্মিক মানুষের কাজ নয়। এছাড়া আমার প্রতিবেশি সে যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেন মানুষ হিসেবে তার একটি মর্যাদা রয়েছে। আমাদের সবার সৃষ্টি একই উৎস থেকে। যদি একই উৎস থেকে মানব জাতির সৃষ্টি তাহলে কেন নিজেদের মাঝে এত মারামারি আর বিভেদ।

আল্লাহতায়ালা কোরআন করিমে হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)কে সম্বোধন করে বলেছেন-‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকীন আযীম’ অর্থাৎ- নিশ্চয় তুমি অতীব মহান চরিত্রের ওপরে অধিষ্ঠিত (সুরা কলম, আয়াত: ৪)। আল্লাহপাকের এ এক বড় নিদর্শন এবং ইসলামের সত্যতার এক মহিমান্বিত প্রমাণ যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের ঘটনাবলী যেরূপ প্রকাশ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেরূপ প্রকাশ্যে অন্য আর কোন নবীর জীবনের ঘটনাবলী বিদ্যমান নেই।

এইরূপ বিস্তারিত-বিবরণ থাকার দরুনই হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর যত বেশি আপত্তি উত্থাপন করা সম্ভব হয়েছে, (নাউযুবিল্লাহ) তত বেশি আপত্তি অন্য আর কোন নবীর অস্তিত্বের ওপর উপস্থাপন করা সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু এতেও কোন সন্দেহ নেই যে, সেই সকল আপত্তি অপনোদনের পর মানুষ যেরূপ পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে এবং পরিতুষ্ট চিত্তে মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সত্তার সাথে প্রেম করতে পারে, সেরূপ প্রেম অন্য আর কোনো মানুষের সাথে কখনই করতে পারে না। কেননা, যার জীবনের ঘটনাবলী গোপন থাকে, তার সাথে ভালোবাসায় বিপত্তি ঘটবার আশংকা সব সময়েই থেকে যায়।

মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন তো ছিল একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ। শত্রুদের যাবতীয় আপত্তি খণ্ডিত হয়ে যাওয়ার পর সেই গ্রন্থের এমন কোনো পৃষ্ঠা আর বাকি থাকে না, যেখান থেকে তার জীবনের অনুরূপ আরো কোনও নতুন দিক বা আপত্তি বের করা সম্ভব। কিংবা তার এমন কোন পাতাও আর বাকি থাকে না, যা খুলে অন্য ধরনের আরও কোন তত্ত্ব বা হাকিকত আমাদের সামনে উদ্ঘাটিত হতে পারে।

হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বিশ্ববাসীর নেতা ছিলেন। রসুল (সা.) নিজের স্বার্থে কোনো প্রতিশোধ নিতেন না বরং শত্রুদের সাথেও তিনি সব সময় ভাল আচরণ করেছেন। যাকে খোদা তা’লা সমগ্র পৃথিবীর জন্য রাহমাতুল্লিল আলামিন করে পাঠিয়েছেন, তিনি কিভাবে অন্যের প্রতি অবিচার করতে পারেন। তিনি (সা.) বিধর্মীদের সাথেও ভাল আচরণ করেছেন। হজরত আবু বকর (রা.) এর কন্যা আসমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.) এর যুগে আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি নবী করীম (সা.)কে জিজ্ঞেস করলাম- আমি কি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ’ (সহিহ বোখারি, কিতাবুল আদব, বাবু সিলাতিল ওয়ালেদেল মুশরেকে)।

হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তার পেশাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি পেশাবের ওপর ঢেলে দেয়া হল’ (সহী বোখারি, কিতাবুল আদব, বাবু আর রিফকে ফিল আমরে কুল্লিহি)।

যতদিন মানুষ মানুষকে না ভালোবাসবে ততদিন পৃথিবী অশান্তই থাকবে, পৃথিবী স্বর্গরাজ্যে পরিণত তখনই হতে পারে যখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষের জন্য প্রেমপ্রীতি জন্ম না নিলে সে মানুষ হয় কিভাবে। সবার সাথে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন মানুষ হিসেবে তার প্রতি প্রীতিময় সম্পর্ক রাখার শিক্ষাই পবিত্র কোরআন থেকে পাওয়া যায়।

মানব সেবায় আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তির প্রতি মহানবী (সা.) শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও তাদের খেয়াল রাখতেন। একবার তাঈ গোত্রের লোকেরা মহানবী (সা.) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এতে তাদের কিছু সংখ্যক লোক বন্দী হয়ে এসেছিল। তাদের মধ্যে আরবের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেম-এর এক মেয়েও ছিল। যখন সে মহানবী (সা.) এর কাছে বললো যে, সে হাতেম-তাঈ এর মেয়ে, তখন তার সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করলেন এবং তার সুপারিশক্রমে তার গোত্রের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন। (সীরাত হালবিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ-২২৭)।

যখন মক্কার লোকেরা আর কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিল না, তখন তিনি (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দিলেন। যখন তিনি (সা.) তায়েফ পৌঁছলেন, তখন সেখানকার নেতৃবৃন্দ তার সাথে দেখা করার জন্য আসতে লাগলো। কিন্তু কেউই সত্য গ্রহণ করতে রাজি হলো না। সাধারণ লোকেরাও তাদের নেতাদেরই অনুসরণ করল এবং খোদার বাণীর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে লাগলো।

দুনিয়ার লোকদের দৃষ্টিতে সহায় সম্বলহীন নবী ঘৃণারই পাত্র হয়ে থাকে। আমি এখানে ঘটনা সংক্ষেপ করছি, কেননা-আপনাদের সকলেরই এ ঘটনা জানা আছে। পরিশেষে তারা সব ভবঘুরে ছেলে ছোকরাদেরকে একত্রিত করলো। তারা প্রত্যেকেই ঝোলা ভর্তি পাথরের টুকরা নিল। তারা নির্মমভাবে মহানবী (সা.)-এর ওপর পাথর ছুঁড়তে থাকে। অবিশ্রান্তভাবে পাথর মারতে মারতে মহানবী (সা.) কে শহর থেকে বাইরে নিয়ে গেল। তার দু’টি পা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। তারপরও তারা ঠান্ডা হলো না, যতক্ষণ না তিনি (সা.) শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন।

এই লোকগুলো যখন তাঁর পিছু পিছু ধাওয়া করছিল, তখন তিনি এই ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন যে, খোদার গযব না আবার তাদের ওপর পড়ে। তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিলেন এবং কাতর প্রাণে প্রার্থনা করছিলেন, “হে খোদা! তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও! কেননা এরা জানে না, এরা কি করছে।’ আঘাতে জর্জরিত ও লোকদের তাড়া খেয়ে তাঁর শরীরে চলার মত আর শক্তি ছিল না।

এত কিছুর পরও তিনি (সা.) তাদের অভিশাপ দেননি বরং তাদের জন্য দোয়াই করেছেন। এমনই ছিলো মানব দরদী রাসুল, শ্রেষ্ঠ রাসুল মহানবী (সা.) এর আদর্শ। আমরা যদি মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, তিনি কতইনা উত্তম আচরণ করেছেন অন্যান্যা ধর্মাবলম্বীদের সাথে আর একই শিক্ষা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তিনি (সা.) যে দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাই এরূপ আযীমুশ্বান নবী (সা.) এর ওপর লক্ষ লক্ষ দরূদ ও সালাম।

আসলে আজ আমরা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে গিয়ে আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে সামান্য বিষয়ের কারণে নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। সব মানুষ চায় শান্তি তারপরও আজ আমরা যেন অশান্তির মাঝে দিনাতিপাত করতেই ভালোবাসি।

যতদিন মানুষ মানুষকে না ভালোবাসবে ততদিন পৃথিবী অশান্তই থাকবে, পৃথিবী স্বর্গরাজ্যে পরিণত তখনই হতে পারে যখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষের জন্য প্রেমপ্রীতি জন্ম না নিলে সে মানুষ হয় কিভাবে। সবার সাথে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন মানুষ হিসেবে তার প্রতি প্রীতিময় সম্পর্ক রাখার শিক্ষাই পবিত্র কোরআন থেকে পাওয়া যায়।

তাই আসুন, আমরা সবাই সবার প্রতি ভালোবাসার ডানা প্রসারিত করি আর বিশ্ব মানবতার প্রতি মমতাশীল হই।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।