মাছ উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশ, ৫২ দেশে রপ্তানিতে আয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা
প্রকাশিতঃ 8:15 pm | July 24, 2023

কালের আলো রিপোর্ট :
এ যেন মাছে-ভাতে বাঙালির প্রবাদ ফিরে এসেছে আবারও। মুক্ত জলাশয় আর ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে চাষের মাছে দেশে ঘটেছে রুপালি বিপ্লব। বিশ্বে স্বাদুপানি ও চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত বিশ্বের সামগ্রিক মৎস্যসম্পদবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে স্বাদুপানির মাছের ১১ শতাংশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ টন।
আবার, ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘মিঠা পানি ও বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়,বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।’ মন্ত্রী ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করেছেন।
মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানিতেও এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানিসহ বিশ্বের ৫২ টি দেশে চিংড়ি, রুই, কাতলা, মৃগেল, কাঁকড়া, কুঁচিয়া, পাংগাস, পাবদা, তেলাপিয়া, শোল, কৈ, শিং, মাগুর ইত্যাদি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী জানিয়েছেন, এসব দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মাছ রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শুধু তাই নয়, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ের পর বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণ বেড়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের।
নানামুখী চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়েই ‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ’– স্লোগানে সোমবার (২৪ জুলাই) থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। নিরাপদ মাছ চাষের প্রচারে সপ্তাহজুড়ে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (২৪ জুলাই) সকালে রাজধানীর মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে চলতি বছরের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে ও রপ্তানিতে বাংলাদেশের সাফল্যের নানাদিক নিজের জবানীতে তুলে আনেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি।
এ সময় তিনি বলেন, ‘মাছের উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিদেশে রপ্তানি সবকিছু মিলে দেশের উন্নয়নে, দেশের মানুষের উন্নয়নে, মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হলে খাবারের একটি বড় যোগান হয়। মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করে মাছ। যারা মাছ উৎপাদন করেন তাদের বেকারত্ব লাঘব হচ্ছে, তারা নিজেরাই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।’
মৎস্য গবেষকরা বলছেন, দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত মাছের জাত এবং তা দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, গাজীপুর, বগুড়া ও কুমিল্লা জেলায় পুকুরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘেরে মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। দেশে মোট কৃষিজ আয়ের শতকরা ২৪ ভাগের বেশি অবদান মৎস্য খাতে। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে করে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন চীনকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানে পৌঁছাবে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি খানা জরিপ বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন একজন মানুষের প্রায় ৬২ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। আর এই আমিষের প্রধান চাহিদার উৎস হচ্ছে মাছ। বাজারে দুই অঙ্কের নোটেই মিলছে মাছ। দাম সাধারণের নাগালে থাকায় দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে শতভাগ।
সরষে ইলিশ, ইলিশ পাতুড়ি, ইলিশ ভাজা হরেক পদের রান্না, হরেক রকম স্বাদ। বাঙালির বর্ষবরণ ইলিশ ছাড়া হয় না। ওপার বাংলায় জামাইষষ্ঠীতে ইলিশ লাগবেই। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যে হারে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে তাতে আগামী কয়েক বছরে উৎপাদন আরও বাড়বে। বিশ্বের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন দেশ হবে বাংলাদেশ।

মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি
রাজধানীর মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে চলতি বছরের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানান, দেশে উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ২০২০ সালে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্র সীমাসহ অন্যত্র যারা মাছ আহরণে সম্পৃক্ত তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের মনিটরিং এর আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি কোনো মৎস্য নৌযান দুর্ঘটনায় পতিত হলে তাদের অবস্থান জানার জন্যও এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাতের অবদান
মন্ত্রী বলেন, নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর ২৪ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট মৎস্য খাত গড়ে তোলা। স্মার্ট মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিকমানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে মাছের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান আসে সেগুলোও এ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাতে মাছ উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে অস্বাস্থ্যকর কোন উপাদান প্রবেশ করতে না পারে। শুধু মাছ উৎপাদন নয় বরং স্বাস্থ্যসম্মত ও খাবার উপযোগী নিরাপদ মাছ উৎপাদন সরকারের লক্ষ্য। আগে আমাদের লক্ষ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি। এখন আমাদের লক্ষ্য দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
তিনি বলেন, মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে মাছের ভোক্তাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে মাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সরকার উৎসাহিত করছে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করতে চায় তাদের সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানারকম সহায়তা প্রদান করছে।
মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে অভয়াশ্রম তৈরিসহ বিভিন্ন সময়ে সরকার মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে উল্লেখ করে এ সময় মন্ত্রী আরও যোগ করেন, মাছ ধরা নিষিদ্ধকালে মৎস্যজীবীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সরকার প্রণোদনা প্রদান, খাদ্য সহায়তা, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও উপকরণ সহায়তা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান একজন মৎস্যজীবীও যেন কষ্ট না পায়।
তিনি বলেন, দেশের জলসীমায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল কাইয়ূম, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এমএএএমকে