৬ বছর পর জট খুলল জোড়া খুনের, প্রকাশ্যে এলো সাজানো ‘নাটক’

প্রকাশিতঃ 5:36 pm | August 02, 2023

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:

২০১৭ সালের নভেম্বরে রাজধানীর কদমতলীর একটি ছাপাখানায় (প্রেস) মিলেছিল চাচা-ভাতিজার লাশ। ওই ঘটনার পরপর সামনে এসেছিল- চাচা ইকবাল ভাতিজা সোহেলকে পিটিয়ে হত্যার করে অনুতপ্ত হলে পরে নিজেও আত্মহত্যা করেন। তবে ঘটনার প্রায় ৬ বছর পর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৪ জনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২৭ সালের নভেম্বরে ‘কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস’ নামের ওই ছাপাখানায় চাচা ইকবাল ও ভাতিজা সোহেলকে হত্যায় জড়িত ছিলেন সেই প্রেসের কর্মচারীরা। যারা হত্যাকাণ্ডের পর লাশ গুমের পাশাপাশি মূল ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভাতিজা সোহেল হত্যার দায় চাপিয়েছিলেন হত্যার শিকার চাচা ইকবালের ওপর।

সে সময় হত্যাকারীরা নিহতদের পরিবারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন- চাচা ইকবাল ভাতিজা সোহেলকে রড দিয়ে পিটিয়ে পালিয়ে গেছে। তবে এ ঘটনায় সোহেলের মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি জেনে পরে অনুশোচিত হয়ে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন ইকবাল। তার লাশ নারায়ণগঞ্জ এলাকায় পাওয়া গেছে। পরে এমন খবরে সে সময় ইকবালের স্ত্রী গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। এরপর ওই ঘটনায় নিহত সোহেলের ভাই বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।

বুধবার (২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ পিবিআইয়ের সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

হত্যার শিকার সোহেল মিয়া টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। সে তার প্রতিবেশী চাচা ইকবাল হোসেনের সঙ্গে রাজধানীর কদমতলীর ‘কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে’ চাকরি করত।

এছাড়া আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতাররা হলেন- আব্দুর রহমান, মোহাম্মদ হাসান, মো. শাহজাহান, জনি মিয়া, মহরদ্দিন মিয়া, কবির, পিয়ার আলী, মামুন, কুপ্পাত খান, জামাল সিকদার, ফরিদ, রহিম বিশ্বাস, নুর আলম ও বাদল হাওলাদার।

পিবিআই প্রধান জানান, মূলত হত্যার শিকার ইকবাল হোসেন ছিলেন একজন পরহেজগার মানুষ। তিনি প্রতিদিন ভোরে উঠতেন নামাজের জন্য। এ জন্য তিনি লাইট জ্বালিয়ে নামাজ পড়তেন। তবে এতে অন্যরা তার ওপর বিরক্ত হতেন। এ নিয়ে সবার মাঝেই দীর্ঘদিন থেকে ক্ষোভ জমে ছিল।

২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ভোরে ছাপাখানার মেসে একইভাবে ফজরের সময়ে ইকবাল উঠলে তার সঙ্গে প্রথমে আব্দুর রহমানের কথা কাটাকাটি হয়। পরে অন্যরা মিলে ইকবালকে মারপিট ছাড়াও শ্বাসরোধে হত্যা করেন। ওই সময় ইকবালের প্রতিবেশী সম্পর্কের ভাতিজা সোহেল তাকে বাঁচাতে গেলে তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করা হয়।

পরে চাচা ইকবালের লাশ গুম করতে আসামি জামালের পূর্ব পরিচিত পিকআপ চালক নূর আলম (৩৫) এবং গাড়ির মালিক বাদলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর ২০ হাজার টাকায় পিকআপ ভাড়া করেন আসামিরা। পরে ‍চুক্তি অনুযায়ী পিকআপ মালিক বাদল ও চালক নূর আলম পিকআপ নিয়ে চলে আসেন প্রেসে। পরবর্তীতে তারা চাচা ইকবালের লাশ গাড়িতে উঠিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় নিয়ে যান। একপর্যায়ে মৃত ইকবালের গলায় গামছা পেঁচিয়ে বরপার ‘বিক্রমপুর স্টিল মিলে’র সীমানা দেওয়ালের সাথে থাকা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যার রূপ দেন আসামিরা।

পিবিআই প্রধান আরও জানান, লাশ গুমের পর হত্যাকারীরা ইকবালের মোবাইল থেকে তার পরিবারের লোকজনকে ফোন করে জানায়- নারায়ণগঞ্জে গাছের সঙ্গে গামছা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ইকবালের লাশ পাওয়া গেছে। পরে খবর পেয়ে ইকবালের স্ত্রী ও ভাতিজা রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে ভিকটিম ইকবালের অর্ধগলিত লাশ শনাক্ত করেন।

এদিকে, মারধরে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দুই দিন পর (৮ নভেম্বর, ২০১৭) সোহেলের মৃত্যু হয়। পরে আসামিসহ অন্যরা নতুন নাটক সাজায়, চাচা ইকবাল ভাতিজাকে রড দিয়ে মেরেছিল। ফলে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজ অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন বরপা বিক্রমপুর স্টিল মিলের সীমানা দেওয়ালের পাশের গাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন।

পরবর্তীকালে ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি ইকবাল আত্মহত্যা করেছেন জানিয়ে মামলার অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয় পুলিশ।

সংবাদ সম্মেলনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই কবির হোসেন বলেন, এ ঘটনায় থানা পুলিশ হত্যার শিকার ইকবাল যেহেতু মারা গেছে, তাই তারা ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছিল। ফলে ওই সময় আসল ঘটনা বেরিয়ে আসেনি। পরবর্তীকালে ২০২০ সালে আবারও মামলার তদন্তের ভার পায় পিবিআই। আমি মাত্র এক বছর কাজ করে লাশ গুম করতে সহায়তাকারী পিকআপ চালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করি। পরে তারা আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে আসামিদের নাম উঠে আসে। এরপর বাকিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

কালের আলো/এমএইচ/এসবি