রাজনৈতিক দলগুলোকেই গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশিতঃ 9:55 am | August 10, 2023

মো. সাইদুর রহমান :

মানুষ গণতন্ত্রের দ্বারস্থ হয় নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। প্রশ্নবিদ্ধহীন গণতন্ত্র বিশ্বের কয়টা দেশে আছে? বাংলাদেশের গণতন্ত্র স্বাধীনতার পর থেকেই ‘নিউনেটাল বেবি’। পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ বিশ্বে ২০টি। কোনও দেশেই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের দিনকাল বর্তমানে ভালো যাচ্ছে না। অনেক দেশ গণতন্ত্র থেকে সরে আসছে, আবার অনেকে নতুন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়েও ভাবছে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে সামনে রেখে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে গতিশীলতা দিয়েছে। দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে জনগণ গণতন্ত্রের সহায়ক মনে করছেন। গণতন্ত্রের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন জনগণ। তা না হলে কবেই জনবিস্ফোরণ ঘটতো বা ঘটাতো।

অধিকাংশ মানুষ মনে করেন অথবা বাস্তবতায় বুঝেন গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে শুধু ভোটের অধিকার। রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের অনেক গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে ভোট প্রদান অন্যতম অধিকার বলাও এখন অতি রঞ্জিত। গণতান্ত্রিক অধিকার হলো, জীবনকে পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কিছু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা।

বর্তমানে বিএনপি যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সেটা ‘উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’। দেশের কী অবস্থা? বিশ্ব পরিস্থিতি কী? পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী? আন্দোলনে কি জনগণকে সম্পৃক্ত করা যাবে? হাতে সময়ই কতটুকু আছে? নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থা কী? তাদের সমমনা দলগুলোর সার্বিক অবস্থা কী? কোনও হোমওয়ার্ক ছাড়াই এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিলো দলটি। বিগত ৫ বছরে আন্দোলনের বীজও তারা রোপণ করতে পারেনি। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন দলের প্রেমে মুগ্ধ। তাদের শরিক দলগুলোর মধ্যে দু-চারটা ছাড়া, অন্য দলগুলোর ভোটের মাঠে অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সংগঠন আছে, সংগঠনের কোনও কার্যক্রম নেই। নির্বাচনি জোটে দল সংখ্যা বৃদ্ধি একমাত্র সহায়ক। বলা যায়, তাদের কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি!

বিএনপির জনসম্পৃক্ততা নেই কিংবা আন্দোলন করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার রাজনৈতিক ক্ষমতাও ক্ষীণ। আন্দোলনে মৌলিক চিন্তাভাবনার কতটুকু আছে? যেমন, প্রথমে নিজের দলের কর্মীদের ও জনগণের মন বা পালস্ বুঝতে হয়। যেকোনও আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতাদের জ্ঞান, প্রেক্ষাপট, ধরন, গতিবিধি, রূপরেখা নিয়ে বাস্তবমুখী ধারণা নিয়ে কর্মসূচি দিতে হয়। সঠিক আগাম পরিকল্পনার অভাবে ফুটো হয়ে যেতে পারে আন্দোলনের বেলুন। যে আন্দোলনে গণতান্ত্রিক অধিকারের রূপরেখা নেই। গণতন্ত্রকে ভর করে শুধু ক্ষমতা নামক সোনার হরিণ পেতে চায়। গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা যে আন্দোলনে উপেক্ষিত সেখানে গণসম্পৃক্ততা কিংবা গণ-আন্দোলনের কোনও সম্ভাবনা নেই। ইতিহাস বলে, কোনও নিদিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের আন্দোলন যদি গণদাবিতে রূপ না নেয়, সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি আসে। যদি বিএনপি এই আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারেন, তাহলে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ান। তখন দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে দলটি। বিএনপি আন্দোলনে যতই কঠিন থেকে কঠিনতম কর্মসূচি ঘোষণা করুক, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, পরিকল্পনার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তার জন্য রাজপথে উত্তাপ ছড়ানো কঠিন হবে। আন্দোলনের মন্থরগতিতে একসময় বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশায় পথভ্রষ্ট হয়ে জানমালের ক্ষতি করবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ দেশের প্রতিটি সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করেন। দেশের মানুষ বর্তমানে গড়তে চায়, ভাঙার বিপক্ষে। জনগণ উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায় পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বিশ্ব তাক লাগানো বাজেটের মতো করে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার পরও দেশের ঊর্ধ্বমুখী বাজেটে কু-নজর পড়েছে বিশ্ব মোড়লদের। এই কু-নজর থেকে রক্ষা করতে দরকার কাজলের টিপস্বরূপ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

বিদেশিরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলানো ভিয়েনা কনভেনশন প্রণীত আইন বিরোধী। বিদেশিদের পক্ষে-বিপক্ষে অযাচিত, শিষ্টাচারবহির্ভূত মাতব্বরি দেশের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতস্থানে লবণ দেওয়ার শামিল। আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন হবে, সেটা দেশের জনগণই নির্ধারণ করবেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য রেষারেষি, অরাজনৈতিক কার্যক্রম, অন্য দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য হিংসাত্মক পরিকল্পনা নতুন কিছু না। কালের সাক্ষী, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থের ঘাটতি হলেই রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায় দেশান্তরে। আমরা মেরুদণ্ডহীন জাতির মতো বিদেশিদের কাছে নালিশ করি। তখন তারা মোড়লগিরি জাহির করার সুযোগটা কাজে লাগায়। দেশের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কোনও দলই পরীক্ষার বাইরে নেই।

আমাদের দেশের প্রতিটি সরকার গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটাই শুধু গণতন্ত্রের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতি ঘটায়নি, বিচ্যুতি ঘটিয়েছে গণতন্ত্রের প্রতিটি বর্ণের। এ দেশের গণতন্ত্র যুগ যুগ ধরে বিবর্ণ হচ্ছে। গণতন্ত্র নিজস্বতা হারিয়েছে, হারিয়েছে তার বাকস্বাধীনতাকে। এর জন্য দায়ী দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন থাকার সময় কোনও দলই নির্বাচন কমিশনকে গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যবহার করেননি।

দেশের রাজনীতিকে আগে সুস্থ ধারায় গতি দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বাঙ্গে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে গণতন্ত্র নিউনেটাল বেবি।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা