বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তার ফসল বাহাত্তরের ৭০ অনুচ্ছেদ

প্রকাশিতঃ 12:45 am | February 06, 2018

তায়েব মিল্লাত হোসেন:

সালটা ১৯৪৫। মার্চ মাস। ২৮ তারিখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান দিন ৮ মে হিসেবে টানলে হিটলারের পতন হতে তখনো বাকি ৪১ দিন। এমনি এক সময়ে ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার পড়ে যায়। এর পেছনে ছিল অতি মুনাফাপ্রবণ মাড়োয়ারিদের কারসাজি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পুস্তকে তাদের ষড়যন্ত্রের বিস্তারি জাল সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু। ‘কয়েক লক্ষ টাকা তুলে লীগ মন্ত্রিসভাকে খতম করার জন্য কয়েকজন এমএলএকে কিনে ফেলল। ফলে এক ভোটে লীগ মন্ত্রিত্বকে পরাজয়বরণ করতে হলো।’ সেই সময়ের ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ঠিক এভাবেই লিখেছেন।

বাঙালির মহত্তম নেতা মুজিব আরো লিখেছেন, ‘এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি! আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল ত্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে।’

তো ছাত্রজীবনে যাকে এমএলএদের পাহারায় রাখতে হয়েছে। তিনি কেন এমপিদের দলবিরোধী অবস্থান নেয়ার সুযোগ রাখবেন? বাহাত্তরের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার পেছনে জাতির জনকের জীবনের এই তিক্ত অধ্যায় হয়তো প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখতে পারে।

তিয়াত্তর বছর আগে যেখানে সরকারি দল ছেড়ে অর্থের প্রলোভনে বিরোধী পক্ষে যাওয়ার ঘটনা আছে, সেখানে আজকের চিত্রটা কেমন হতো। তা জানতে চলুন আমরা একটু ঘুরে আসি রূপকথার দেশে। হীরক রাজার দেশটাকেই সময়ের বদলে নামকরণ করে বলি গণপ্রজাতন্ত্রময় হীরক দেশ। সেইখানে একখান ভোট কমিশন আছে। তাদের নিবন্ধনে দল সংখ্যা হয়তো গোটা চল্লিশেক। এরই মাঝে দুইখান মাত্র বড় দল পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে সবসময় মাঠে থাকে। বাকিরা তাদের লেজুড় হিসেবে দাক্ষিণ্য নিয়ে টিকে আছে। সেই কারণেই পর্ষদে ছোট দলের কিছু বড় নেতা পারিষদ হতে পেরেছেন। বেশি ভাগ্যবান যারা সরকারি জোটে থাকার সুবাদে উজির-নাজিরের তালিকায়ও উঠতে পেরেছেন। হীরক দেশের পারিষদদের কিন্তু রাগ-মান-লোভ করার সুযোগ অনেক বেশি। কারণ তাদের শাসনশাস্ত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ বলে কিছু নেই। তাই পারিষদদের কেউ কেউ পর্ষদে সকাল-বিকাল স্থান বদল করেছেন এমন ঘটনাও আছে। যাই হোক বড় দলের প্রধানরাই ঘুরেফিরে পর্ষদের প্রধান নেতা বা বিরোধী নেতা হন।

সেই হীরক দেশেই একজন মস্ত বণিক ছিলেন। হঠাৎ-ই তার খায়েশ হলো তিনিই পর্ষদ-প্রধান হবেন। সেই সুবাদে হয়ে উঠবেন নির্বাহ শাখার সর্বময় ক্ষমতাবান। যেই কথা সেই কাজ। একজন হলেও পারিষদ আছে, প্রথমেই এমন একটির দল-প্রধান হয়ে উঠলেন বণিক। এক রাতেই ডান-বাম-মধ্য সব ধারার দল থেকে পারিষদদের দলে বেড়ালেন। সংখ্যাগুরু হওয়া-ই যথেষ্ট ছিল ক্ষমতায় আসতে। কিন্তু ছোট্ট দলটিতেই দুই-তৃতীয়াংশ পারিষদ না ভেড়ানো পর্যন্ত থামলেন না তিনি। পয়সাকড়ি কোনো ব্যাপার নয় তার কাছে। পয়সার কাছে অনায়াসে বিক্রি হতে লাগলেন পারিষদরা। আরো বেশি কড়ি দিয়ে বিক্রীত একজন পদ ছাড়লেন। তার আগে নিশ্চিত হতে হয়েছে, যাতে সেখান থেকে সহজেই ভোটের বৈতরণী পার হতে পারেন ছোট দলের নবাগত সেই বড় বণিক। উপনির্বাচনের পর তিনিও এখন পারিষদ। তার দল নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ক্ষমতাসীন বড় দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনাস্থা আনতে আর কী চাই! এরপর যা হওয়ার তাই হলো।

এবার বাস্তবে ফিরি। অবিভক্ত ভারতে যেমন, বিভক্ত ভারতেও কিন্তু দলবদলের সুযোগে অন্ধকার পথে কামাই করেছেন সাংসদরা। তার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ এক পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ। শোনা যাক তার সাম্প্রতিক এক বয়ানে:

‘১৯৯৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। শিখতে গিয়েছিলাম। ক্ষমতাসীন দল কয়েকজন সংসদ সদস্যকে কিনেছিল। পরে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের বিরুদ্ধে মামলা এবং বিচারিক আদালতে তিনি দণ্ডিতও হয়েছিলেন। এটা বন্ধ করতেই ৭০ অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। এর প্রয়োগ শুধু প্রধানমন্ত্রীর অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবিলার ক্ষেত্রে।’

এর মানে দাঁড়ায়, সরকারপ্রধানের প্রতি দলের সাংসদরা যাতে অনাস্থার প্রশ্ন এলে সংসদে আস্থা রাখে তার জন্যই ৭০ অনুচ্ছেদ। চলুন চোখ বুলিয়ে নেই সেই অনুচ্ছেদে।

‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-

(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা

(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,

তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

এই বিপক্ষে ভোটদানের সুযোগ না রাখার বিষয়টি নিয়ে মহামান্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিদারুণ আপত্তির কথা জানিয়েছেন ষোড়শ সংশোধনী নাকচের পুরো রায়ে। সেখানে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে:

‘৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় হাই কোর্ট বিভাগ যে মর্মার্থ গ্রহণ করেছে আমরা তাতে অযৌক্তিকতা দেখি না এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে বলা যায় যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের তাদের পদ থেকে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যগণ নিঃসন্দেহে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলের হুকুম তামিল করতে বাধ্য থাকবেন। ফলশ্রæতিতে বিচারকগণ তাদের পদরক্ষার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে রাজনৈতিক দলের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। আমাদের এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াতে মোটেও বুল নেই।’ [পৃষ্ঠা: ২৮১-২৮২]

পরে অনেক অভিযোগের মুখে চাপে পড়েই পদত্যাগী হওয়া সেই মাননীয় প্রধান বিচারপতি সেই রায়ে আরো লিখেছেন:

‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশনা উপেক্ষা করে একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে কখনো স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে না।’ [পৃষ্ঠা: ২৮৪]

কিন্তু ফাঁকফোকর যেমন একই আইনের আলাদা চেহারা প্রস্ফুটন ঘটাতে পারে, তেমনি বিচারকভেদেও ভিন্ন ভিন্ন রায় আসতে পারে। কারণ চেতনায়, দর্শনে ভিন্ন ভিন্ন মত থরে থরে থাকতে পারে। আসলে এই হচ্ছে সভ্যতার সুন্দরতম পথ। এই পথেরই পথিক হওয়ার প্রবণতা রয়েছে আমাদের বিচারাঙ্গনে। এই তো দিন কয়েক আগে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে বিভক্ত আদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে আসন শূন্য হওয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল একটি রিট আবেদন করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। এই প্রসঙ্গেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। অন্যদিকে বিচারপতি আশরাফুল কামালের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে রিট আবেদনটিই খারিজ করে দেন। নিয়ম মেনে বিষয়টি এখন প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি রিট শুনানির জন্য নতুন একটি একক বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন। সেই বেঞ্চেই এর নিষ্পত্তি হবে।

কেন রাখা যাবে না ৭০ অনুচ্ছেদ- এ প্রসঙ্গে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য:

‘সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। দল যা বলবে এমপিরা তাই করবে- এমন হওয়ার জন্য জনগণ তাদের ম্যান্ডেট দেয়নি। জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছে যাতে স্বাধীনভাবে তাদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন, জনস্বার্থে কাজ করেন। এখানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সব ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে রাজনৈতিক দল, জনগণ নয়। এসব কারণে এটা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

অপরপক্ষে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের আদেশ হচ্ছে গিয়ে-

‘১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। সে সময় যেভাবে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেভাবেই রয়েছে। এ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে অতীতে কোনো সরকার বা সংসদে প্রশ্ন ওঠেনি। জনগণও প্রশ্ন তোলেনি। ৭০ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার হয়েছে এমন নজিরও আমাদের সামনে নেই।’

বরং ৭০ অনুচ্ছেদ না থাকলে দল বদলের সুযোগ অপব্যবহারের শঙ্কা বেড়ে যায়। ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে প্রলোভনে পড়ে সর্বোচ্চ স্তরের জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে সরকারকে অনিশ্চিত করেছেন, সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় আসার পথ উসকে দিতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ আমলে তা এড়াতে চেয়েছেন জাতির জনক। তাই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কোনো উড়ে এসে জুড়ে বসা বিষয় নয়। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত এক খাঁটি সিদ্ধান্তেই এসেছিলেন বাঙালির মহত্তম নেতা। আরাম-কেদারার অনুচ্ছেদ-সত্তর সমালোচকরা তা ঠিক ঠাহর করতে পারবেন না।

 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক