মার্কিন ভিসানীতি; পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন
প্রকাশিতঃ 5:01 am | October 05, 2023

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর বদলে গেছে দেশের রাজনীতির চালচিত্র। সেপ্টেম্বরে এই ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার পর এখনও তোলপাড় চলছে রাজনীতিতে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাইরের দেশ থেকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশের জনগণও তাদের স্যাংশন দেবে।
কাদের ওপর এবং কেন বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে—সে প্রশ্নের শক্ত জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। ভিসা নীতি নিয়ে চাপের বিষয়টিও তিনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে বুধবার (০৪ অক্টোবর) দুপুরে দেশে ফিরে বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারি। পারি না? নিশ্চয়ই পারি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারি। এগুলো সময়মতো জানবেন।’ শুধু তাই নয় নিজের বক্তব্যের এক পর্যায়ে বাংলাদেশেরও ভিসা নীতির কথাও তুলে ধরেন সরকারের অভিজ্ঞ এই মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ভিসা নীতি সব দেশে আছে। আমাদের দেশেও আছে। আমরা সবাইকে ভিসা দিই না। আমরা ব্যক্তিবিশেষ কিংবা কোনো দেশকে কম ভিসা দিই।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সময়োপযোগী এমন বক্তব্যের মাধ্যমে কার্যত বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। নিজেদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হলেও মার্কিন ও তাঁর মিত্রদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে ত্যক্ত বিরক্ত এই দেশের মানুষ। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। রক্তের দামে কেনা দেশের মর্যাদাকে খাটো করে অযাচিত চাপের লক্ষ্যবস্তু করা এবং কূটনীতিকদের চলমান অপতৎপরতা বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় একাধিকবার তাদের সতর্ক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী ড.মোমেন বুধবার (০৪ অক্টোবর) গতকালও বলেছেন-‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির মূল উদ্দেশ্য—যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। আমরাও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তারা আমাদের সঙ্গে একমত।’
ভিসা নীতি নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করেন না দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সময় আরও বলেন, ‘যারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করে, তাদের জন্য হয়তো দু:সংবাদ, যদি দুষ্টলোক হয়। আমেরিকা তো সবাইকে ভিসা দেয় না। কয়েক হাজার লোক বছরে ভিসার জন্য আবেদন করে, এর মধ্যে কত লোককে ভিসা দেয়?’
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মার্কিন নীতি অনুযায়ী যারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে বাধা হবে, তারাই মার্কিন ভিসা পাওয়ার অযোগ্য হবেন। এই নীতি সরকারি ও বিরোধী দল সবার জন্যই প্রযোজ্য। তাই গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি ও বজায় রাখার দায় যেমন সরকারি দলের, তেমনি বিরোধী দলেরও। অবাধ ও সুষ্ঠু না করতে পারলে সেটা অবশ্যই নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দলের ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে। আবার নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহতের চেষ্টাও মার্কিন নীতির পরিপন্থি হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে নিজের অভিমত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যারা নির্বাচনে আসবে না, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে নেই। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই নেই। কিন্তু তারা বিশ্বাস করে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র সুযোগ। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং গণতান্ত্রিক সরকার চায়। আমরাও গণতান্ত্রিক সরকার চাই।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার (০৩ অক্টোবর) বলেছেন, ‘তলেতলে সবার সঙ্গে আপস হয়ে গেছে।’ তাহলে কি ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস হয়েছে, সে প্রশ্নও করা হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কৌশলী জবাবে তিনি বলেছেন, ‘উনি (ওবায়দুল কাদের) বলেছেন, ওনার কাছে জিজ্ঞেস করেন। ভিসা নীতি আমাদের জন্য গুরত্বপূর্ণ কিছু নয়। উনি (ওবায়দুল কাদের) ঠিকই বলেছেন।’
বিদেশিদের চাওয়া–পাওয়া ও চাপ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড.মোমেন সাফ সাফ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু মান–ইজ্জত বেড়েছে ও উন্নয়ন হচ্ছে, ফলে সবাই আমাদের কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়। তাই আমাদের সঙ্গে এসে দেখা করে। আগে এত মানুষ দেখা করত না। বিদেশিরা মূলত তাদের পণ্য বিক্রি করতে আসে। এ জন্য চাপ সৃষ্টি করে, যেন তার কাছ থেকে পণ্য কেনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়, ফ্রান্স তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়, যুক্তরাজ্য তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়, ইউরোপ তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের ছবক দিলেও; তারা আয়নায় নিজেদের চেহারাটা একবারও দেখে না। গত নির্বাচনের পর তাদের সমর্থকদের তাণ্ডব বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। হুটহাট বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে স্কুল, শপিং মল, হাসপাতালে গিয়ে শ্যুটিং প্র্যাকটিস করার মতো হত্যার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেই ঘটে, বাংলাদেশে নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.মোমেন বরাবরই মার্কিনিদের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো মনে করিয়ে দিয়েছেন। বুধবারের (০৪ অক্টোবর) তাঁর বক্তব্য থেকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র কারও কাজে ‘লিজ’ দেওয়া নয়। ক্ষমতার পরিবর্তনের একমাত্র পথ নির্বাচন। জনগণ ভোট দিলে সেটিই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।’
কালের আলো/এমএএএমকে