এমপি প্রার্থীদের ৩০০ কোটি টাকায় ‘মনোনয়ন’ দেন তুষার!

প্রকাশিতঃ 6:01 pm | October 18, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

বিভিন্ন সংসদীয় আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নাম ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়া। এরপর যাদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ তাদের টার্গেট করতেন। যোগাযোগে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে কারো কাছে ৫০ কোটি, কারো কাছে ২০০-৩০০ কোটি টাকা দাবি করতেন। দামি হোটেলে সাক্ষাৎ করতে যেতেন দামি গাড়ি নিয়ে।

হানিফের তৎপরতায় মনোনয়নপ্রত্যাশী ১০ থেকে ১১ জন ইতোমধ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। শুধু সংসদ সদস্য মনোনয়নই নয়, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন বা পদোন্নতির আশ্বাস দিয়ে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে বিপুল অঙ্কের অর্থ দাবি করতেন তিনি।

সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদ পাইয়ে দেওয়া, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতসহ প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ জনের বেশি ব্যক্তিকে চাকরি পাইয়ে দেওয়াসহ প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) রাতে র‍্যাব-১ এর একটি দল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা আবু হানিফ তুষার ওরফে হানিফ মিয়াকে (৩৯) গ্রেপ্তার করা হয়।

এ সময় তার কাছ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র, অ্যামুনেশন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ও বিভিন্ন ভিডিও এবং এডিট করা ছবি উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায়।

বুধবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, আবু হানিফ দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নিকটাত্মীয় হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ও সুসম্পর্কের কথা বলে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করে আসছিল। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে মনোনয়ন প্রাপ্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে আসছিল।

তিনি প্রতারণার জন্য বিভিন্ন সময় নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতেন। এমনকি দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বেনামি মোবাইল নম্বর প্রধানমন্ত্রীর নামে তিনি নিজেই অথবা চক্রের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ম্যাসেজ আদান-প্রদান করতেন। চ্যাটিংয়ে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের সদস্যদের নামে মোবাইলে সেভ করতেন।

কমান্ডার মঈন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস থেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য সেজে পদে পদায়ন ও পদোন্নতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া সংক্রান্ত ও বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ দাবি সংক্রান্ত বার্তা নিজ চক্রের সদস্যদের সঙ্গে আদান-প্রদান করতেন। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজের ছবি এডিট করে বসাতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মিথ্যা দাবি করে টার্গেট করা ব্যক্তিকে প্রেরণ করতেন।

তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তার টার্গেট করা ব্যক্তিকে দেখাতেন ও প্রেরণ করতেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, আবু হানিফ এইচএসসি পাস হলেও তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন বলে মিথ্যা পরিচয় দিতেন। ২০০৮ সালে মোটরপার্টসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরিবহন খাতে দেশের বিভিন্ন রুটে তুষার এন্টারপ্রাইজ পরিবহন নামে তার বেশ কয়েকটি বাস ও নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রাইভেটকার রয়েছে। তিনি ঢাকার নাখালপাড়া এবং ধানমন্ডি এলাকায় দলীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন বলে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন।

২০১৪ সালের পর থেকে একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতারণার কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌশলে রাজনীতিবিদ, উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পরিচিতি বাড়ান। পরে সুসম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অফিস বা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছবি তোলেন এবং প্রতারণার কাজে ছবিগুলো ব্যবহার করতেন।

২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেন হানিফ। বিভিন্ন সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে অনুষ্ঠান, সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ করে ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোডের মাধ্যমে তার পরিচিতি ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান স্পন্সর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসার চেষ্টাও করেছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে এবং মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা জানতে পেরেছি ১০-১২ জনকে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন হানিফ। ২০১৫ সালে হানিফ যে ব্যক্তির পিএস হিসেবে কাজ করতেন, তাকেও মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি এভাবে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলাফেরা ও সেখানে ছবি রয়েছে– এ বিষয়ে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যে ছবিগুলো রয়েছে সেগুলো এডিট করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করতে এগুলো তৈরি করেছেন তিনি। এই এডিট ছবিগুলো দেখিয়ে তিনি অনেকের সন্নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই ছবিগুলো দেখিয়ে ও প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় বলে কার্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয় তার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি অভিনব কৌশল অবলম্বন করে পরিচিত হন। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলেও তিনি গিয়েছেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। যারা এ ধরনের প্রতারণা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে র‍্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে।

কালের আলো/এসবি/এমএম