আজ কী হবে ঢাকায়?
প্রকাশিতঃ 6:00 am | October 28, 2023
কালের আলো রিপোর্ট :
আজ শনিবার (২৮ অক্টোবর)। সেই উত্তেজনার ক্ষণ। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চারিদিকে। এদিন দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে জনমনে তৈরি হয়েছে চরম ভয়ভীতি। রাজপথ যেন হয়ে ওঠতে যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দান। প্রায় ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল ইতিহাসের এমন ভয়াল এক দিন। ওইদিন রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দিনে-দুপুরে বর্ণনাতীত নৃশংসতা দেখেছে বিশ্ব। সেদিন সরকার হঠাতে একদল লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল। আরেক দল প্রস্তুতি নিয়েই তা ঠেকানোর জন্য মাঠে ছিল। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের ভয়াবহ পরিণতি দেখেছিল বিশ্ব। ১৭ বছর পর আজ ২৮ অক্টোবর একই ধাচে রাজপথে নামছে দুই দল।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ২০ শর্তে পছন্দের জায়গায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’কে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ডিএমপি। আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট এবং বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করবে। ডিএমপি কার্যালয়ে সাংবাদিকের সামনে এই তথ্য নিশ্চিত করেন ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন।
আর বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী শাপলা চত্বরে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। কোনো মতেই শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে পিছুটান নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে দলটি। তবে জামায়াতকে কোনোভাবেই মাঠে নামতে দেবে না বলে আগেই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে ডিএমপি।
এদিকে, দুই দলের সমাবেশ কেন্দ্র করে ঢাকার প্রবেশমুখ সাভারের আমিনবাজারে পুলিশের কঠোর তল্লাশি অব্যাহত ছিল। যাত্রীবাহী বাসে উঠে পরিচয়পত্র ও মোবাইল তল্লাশির পরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে ঢাকায়। শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ৮টা থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম শুরু করা হয়। সকাল ১০টা থেকে চেকপোস্টে আরও কঠোরভাবে তল্লাশি করতে দেখা যায়। পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সদস্যরাও অংশ নিয়েছে এই কার্যক্রমে। এতে সড়কে যানবাহনের ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে র্যাবও। দুই দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা ও যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে রাজধানীতে র্যাবের দেড় হাজারের অধিক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক সিনিয়র এএসপি আ ন ম ইমরান খান। তিনি বলেন, র্যাব সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট পরিচালনা, টহল কার্যক্রম, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি পরিচালনা করছেন।
জানা যায়, নির্বাচনকালীন সরকারের ৯০ দিন শুরুর আগ মুহূর্তে এসব কর্মসূচি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সব মহল। বিএনপির ঢাকায় বসে পড়ার ভয় তাড়া করছে সবাইকে। কারণ দুই কোটি মানুষের এ শহরে রাস্তা বন্ধ করে বসে পড়লে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কর্মসূচি রুখে দিতে মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এদিন ঢাকায় ১০ লাখ লোকের সমাগম করে বিএনপির রাজনৈতিক কবর রচনার হুমকি দিয়েছেন নেতারা। পাশাপাশি ঢাকা দখল করতে এলে ‘প্যাদানি’ দিয়ে বুড়িগঙ্গা পার করে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) বিকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির শনিবারের মহাসমাবেশের বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। এদের দুরভিসন্ধি আছে। সাম্প্রদায়িক আরও দু-একটি শক্তিকে নিয়ে তারা অশুভ খেলার পরিকল্পনা নিচ্ছে। সার্বক্ষণিক সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। মিটিং শেষে চলে গেলেই হবে না। কাল একটু দেখেশুনে যাবেন। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।’
শান্তি সমাবেশ শেষ হলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে মনে না করতে নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সবাই নিজে নিজে দায়িত্ব নেবেন, সবার দায়িত্ব আছে। এই যুদ্ধ আমাদের সবার। এটা বাংলাদেশের আরেক মুক্তিযুদ্ধ। এটা মনে করেই মাঠে থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করতে পারবো, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। এটা মাথায় রেখেই নৌকা বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা শান্তি সমাবেশ করছি, আগামীকালও শান্তি সমাবেশ করবো। আমরা অশান্তি করতে চাই না, আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ চাই, আমরা নির্বাচনের পরিবেশ চাই শান্তিপূর্ণ। কাজেই আমাদের দ্বারা কোনও প্রকার অশান্তি সৃষ্টির সুযোগ নেই। আমরা কেন অশান্তি করবো? অশান্তি তারা চায় যারা এই নির্বাচন করতে আগ্রহী নয়। তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তারা দেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, নাশকতা সৃষ্টি করে গোটা পরিবেশটাকে অশান্ত করতে চায়।
শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে চাঁদপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সমাবেশের নামে বিএনপির সহিংসতা করার পরিকল্পনা আছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আওয়ামী লীগের এ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সমাবেশের নামে বিএনপির সহিংসতা করার পরিকল্পনা আছে, কারণ বিএনপি-জামায়াতের এমন অতীত রেকর্ড আছে।
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ শান্তির সপক্ষে ও মানুষের অধিকারের পক্ষে। সেই দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সবসময় পালন করে এসেছে। তাই সরকারের পাশাপাশি দলও দায়িত্ব পালন করবে। বিএনপি সমাবেশের নামে সহিংসতা করার পরিকল্পনা আছে বলে জনমনে আশঙ্কা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের মতো এমন একটি দেশে সহিংসতা করা কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত নয়।
দুই দলই নিশ্চিত করেছে সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপিকে এবং বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট এলাকায় আওয়ামী লীগকে শনিবার (২৮ অক্টোবর) সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তবে এতে ২০টি শর্ত জুড়ে দিয়েছে পুলিশ। শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ. মহিদ উদ্দিন এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কাছে আমরা সাতটি বিষয় জানতে চেয়েছিলাম। দলের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে চিঠিতে তারা যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছে- আশা করবো সেগুলো তারা অনুসরণ করবে। দুই দলই নিশ্চিত করেছে তাদের সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। আমরা নিরাপত্তা দিতে চাই যারা সমাবেশে আসবে, আমরা নিরাপত্তা দিতে চাই ঢাকাবাসীর। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সহযোগিতা করবে।’
দুই দলকে ২০টি শর্ত দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘শর্ত না থাকলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা হতে পারে। শর্তগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কী কী করা যাবে, সমাবেশে কখন আসবে, কখন আসবে না- সবকিছুই শর্তে বলা আছে।’ বিএনপির সমাবেশে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেসব শর্ত দেওয়া আছে সবগুলো আইনি কাঠামোর মধ্যে দেওয়া আছে।
এর আগে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের জন্য বিএনপির কাছে সাতটি তথ্য জানতে চেয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। গত বুধবার রাতে দলটিকে যে চিঠি দিয়েছিল, তার জবাবে বিএনপি জানিয়েছে, নয়াপল্টন ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় তাদের। পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন মিয়ার পাঠানো চিঠির উত্তরে বৃহস্পতিবার দুপুরে রুহুল কবির রিজভী পল্টন থানার ওসির কাছে একটি চিঠি পাঠান। তাতে বলা হয়, ২৮ অক্টোবরের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ের সামনে বেলা ২টায় শুরু হয়ে মাগরিবের আজানের আগে শেষ হবে। সমাবেশে একলাখ থেকে সোয়া লাখ লোক হতে পারে। সমাবেশটি পশ্চিমে বিজয়নগর মোড় ও পূর্বে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। সমাবেশের জন্য পশ্চিমে বিজয়নগর মোড় এবং পূর্বে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত কিছুদূর অন্তর অন্তর মাইক লাগানো হবে। ২৮ অক্টোবর সমাবেশে বিএনপির নেতারা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করবেন না। সমাবেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দলের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন যার সংখ্যা হবে ৫০০ জন।’
উদ্ভূত সংকটের সমাধানে বিশিষ্টজনদের তাগিদ
উদ্ভূত সংকটের সমাধানে বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা। তাদেরই এটির সমাধান করতে হবে। সংকটের সমাধান রাজপথ দখল করে হবে না, আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।
আজ ২৮ অক্টোবর তিন দলের কর্মসূচি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘সংঘাত হতেই পারে। সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। টাকা দিয়ে যাদের আনা হবে রাস্তায়, তারাই তাদের মধ্যে গণ্ডগোল করবে। এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কের কিছু নেই। সাধারণ মানুষ বাসা থেকেই বের হবে না।’
রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সংঘাত তো রাজনীতিকরা বুঝবে। রাজনীতিকরা নিজেদের কথা ভাবে, সাধারণ মানুষের কথা ভাবে না, ভাবলে দুই দল মিলে রাস্তা বন্ধ করতো না। যার কারণে এই অবরোধ কর্মসূচি এবং তার প্রতিরোধের কর্মসূচি। অবরোধের কর্মসূচি না দিলে প্রতিরোধের ব্যাপার আসতো না। আবার আওয়ামী লীগ যখন জনসমাবেশ করবে, তারাও প্রতিরোধ করবে। রাজনীতিকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার দায় রাজনীতিবিদদের, সাধারণ মানুষের নয়। সাধারণ মানুষ খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত। শহরটা এমনিতেই অচল। তারপরও তারা সম্পূর্ণরূপে অচল করে দেয়, এটি কাম্য নয়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এক দল আন্দোলনের মাঠে কর্মসূচি দিয়েছে। আরেক দল যদি এটা প্রতিহত করার জন্য মাঠে নামে, তাহলে সংঘাতের শঙ্কা দেখাই দেয়। আপনি যদি আগুন দিয়ে আগুনকে প্রতিহত করতে চান, তাহলে আপনাকে ছাই-ভষ্ম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটাই বাস্তবতা। তবে, এ পর্যন্ত আমরা যেটা দেখেছি, বিরোধী দল চেষ্টা করেছে অহিংস থাকতে, সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে। আমরা আশা করব যে, পুলিশ যদি বাড়াবাড়ি না করে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি ভূমিকা না নেওয়া হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণই হবে। আর শান্তিপূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ সহিংসতা হলে সবারই ক্ষতির কারণ হবে। সমাধানের পথ রাজপথ নয়, আলোচনার টেবিলে খুঁজতে হবে।
কালের আলো/ডিএস/এমএম