অন্ধ অনুকরণই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উত্থানে প্রধান অন্তরায়

প্রকাশিতঃ 4:14 pm | November 13, 2023

শারমিন সুলতানা:

প্রবাদ মতে, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বয়সে বড়রা কিংবা সমবয়সী অন্যজনকে শিশুরা যা করতে দেখে নিজেও তা-ই করে বা করার চেষ্টা করে। এটি করতে গিয়ে তারা নানান সময়ে অনেক বিপদজনক কাজে যুক্ত হয় ও নিজের বড় ক্ষতি করে ফেলে। শিশুরা অন্যের মুখে যা শোনে তা-ই করে, যা করতে দেখে তা-ই করে। কারণ ভালো মন্দ বোঝার বা কোন কাজটি তার জন্য ক্ষতিকর তা বোঝার মানসিক শক্তি বা বোধ বুদ্ধি তার নেই। এ জন্য আমরা সব সময় সচেতন থাকার চেষ্টা করি যে শিশুর সামনে যেন কোনো ভুল শব্দ বা বাক্য উচ্চারিত না হয় কিংবা ভুল কাজ করা না হয়। এভাবে সর্তক থেকে আমরা অবোধ শিশুকে অনুকরণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। কারণ অনুকরণ তার জন্য ক্ষতিকর৷ কিন্তু বড়দের বা যাদের বোধ জ্ঞান আছে বলে আমরা ধারণা করি বা আশা করি তাদের অনুকরণ রোগ থেকে কী করে আক্রান্ত হওয়া থেকে আটকানো যেতে পারে সেটি একটি নতুন প্রশ্ন হয়ে সামনে দাড়িয়েছে।

আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য বা যুগধর্ম হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা। ব্যক্তি বলায়, চলায়, আচরণে, চিন্তা চেতনায় নিজের বোধ বুদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে এটিই কল্যাণের পক্ষে কাম্য। কারণ আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক নিয়মে, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ধ্যান- ধারণায়, জীবন পরিচালনাকারী আকাঙ্খায়, আদর্শে, অনেক বিতর্কিত বিষয় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করার উদ্দেশ্যে এক সময় সৃষ্টি হওয়া এ বিষয়গুলো কালক্রমে মানুষের কল্যাণের অন্তরায় হয়ে গেছে। পরিবর্তন, সংশোধন ও পুনর্বিবেচনা এখন জীবনের দাবি। কিন্তু তা করবে কারা? সাধারণত শিক্ষিত ও বোধ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ নিজের নিজের চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে অন্যের মতোন না ভেবে নিজের মতোন বোধ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বহুকাল ধরে চলে আসা অন্যায় বা সময়ের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ নিয়মগুলো সংশোধিত করবে এটিও প্রত্যাশিত৷ কিন্তু এটি হচ্ছে কতটুকু?

ছোটরা যেমন অন্যের অনুকরণ করে তেমনি ধনী-গরিব, শিক্ষা বঞ্চিত বা শিক্ষিত, তথাকথিত নিচু শ্রেণি থেকে উঁচু শ্রেণি, যিনি শেখে তিনি ও যিনি শেখায় তিনিও অনুকরণই করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আমাদের ব্যবস্থায় নতুন কিছু ভাবাই অপরাধ। একশ্রেণির মানুষ বিশেষ করে অবস্থানে বড়, প্রবীণ বা ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কথার অন্ধ অনুকরণ না করাকে নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে হুমকির স্বরূপ মনে করেন। এমন কি নতুন চিন্তা যদি তিনি নিজেও করেন থাকেন তবে নিজেই যেন নিজের বিপক্ষে চলে যান।

আমাদের নবীন প্রজন্ম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে পারদর্শী৷ বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা নিজের পোশাক থেকে আরম্ভ করে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবহার্য জিনিসপত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অন্যের অনুকরণ করার মধ্যে দিয়ে তৃপ্তি খুঁজে পায়। শুধু তাই নয়, কোন বিষয়ে সে পড়াশোনা করবে, কোন বিষয় নিয়ে ক্যারিয়ার তৈরি করবে, কোন আদর্শ বেড়ে উঠবে তার সবটাই ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধু- বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি বা আত্মীয়-স্বজনদের পছন্দ অনুযায়ী তারা নির্বাচন করে থাকে। এসবের মধ্যে যে নিজের নিজস্ব চিন্তার জায়গাটি আজন্ম অব ব্যবহৃত থেকে যায় তা সে কখনো বুঝতেই পারে না। অথচ সেও হতে পারত নতুন কোনো চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।

আমাদের প্রবীণরাও নিজের জীবনের কাছে অন্যের মতোন একটা সাধারণ অবস্থানই চান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ঠিক যেন অন্যকে দেখানোটাই আমাদের আত্মতৃপ্তির মূলে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে কাজ করে। আমরা যেন দিন দিন অন্যের রুচি মতোন নিজেদের সাজাতে চাই। প্রতিষ্ঠা বলতে আর দশজন যা ভাবে সেটাকেই প্রাধান্য দেই। নিজের মতোন করে নিজের আত্মতৃপ্তি ভিন্ন কিছুতে খুঁজে পাওয়াটা আমাদের হয় না। তাই পুনরাবৃত্তি আমাদের পারিবারিক জীবন থেকে আরম্ভ করে সামাজিক ও জাতীয় জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যে ভুল একবার কোনোভাবে প্রতিষ্ঠা পায় সেভুল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের মাথা নিচু করে দেয় জীবনভর। আর আমরা ভাবি এমনটাই স্বাভাবিক, সবাইতো এমনই চায় কিংবা এটাই আজকালকার ট্রেন্ড। আপাতত দৃষ্টিতে এ বিষয়টিকে গল্পের নির্বাচিত সংলাপ বলে মনে হলেও এ অনুকরণপ্রিয়তা বা এ অনুকরণপ্রিয় স্বভাবের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে আমরা অনেকের তালিকায় এমনভাবে হারিয়ে যাচ্ছি যে অনেকের মধ্যে একজন বা অন্যতম হওয়া আমাদের অনেকেরই হয়ে ওঠে না। ফলে আধুনিক যুগে আমরা ক্ষেত্র বিশেষে হয়ে পড়ছি অনাধুনিক।

আলাদা করে ভাবা কিংবা আলাদা চিন্তা করার মানে সকল নিয়মকে অস্বীকার করা নয়, বরং নিজের বোধ ও বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে নিজের জায়গা থেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এতে করে বৈচিত্র্যপূর্ণ বোধনের ছোঁয়ায় আমাদের আত্মার আস্তাবলের পচনশীল অভিপ্রায়গুলো একটু সজীবতার স্পর্শে প্রাণ পায়। একটু ভিন্নতা আসে আমাদের চিন্তায়। রক্ষা পায় আমাদের অন্যে বিলীন ব্যক্তিসত্তা। আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের যে অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রয়োগ অন্ধ অনুকরণের কারণে কখনোই করা হয়ে উঠে না তা প্রাণের স্পর্শ পায়। অন্যের হেঁটে যাওয়া পথ হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকেই জানতে পারিনা যে আমাদের গন্তব্য ভিন্ন পথে অপেক্ষমান। অথবা যদি কখনো বুঝতে পারিও তখন এতটা দেরি হয়ে যায় যে নতুন করে আবার যাত্রা শুরু করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফল একটি এমন জীবন যা কেবল বয়ে বেড়ানোই লাগে দায়হীনভাবে। সে জীবনে ফুল-ফলে প্রকৃতিকে ভরিয়ে দেওয়া বা নিজেকে কর্ষণ করা আর হয়ে ওঠে না। অনাবাদি জমিতে পরিণত হয় উর্বর জীবন জমিন আমাদের।

আমাদের প্রত্যেকের নিজের কোথায় ভালো লাগে, নিজের কোনটা ঠিক মনে হয়, নিজের সম্ভাবনার জায়গা কোনটি কিংবা কোনটি ঠিক আমার কর্মক্ষেত্র হতে পারে সেটি আলাদা করে দেখা প্রয়োজন৷ তবে হয়ত জীবনের অপচয় কমে আসবে, কমবে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির গতিগত বন্ধ্যাত্ব।

লেখক: শারমিন সুলতানা। শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।