মাতৃভূমি রক্ষায় ব্রত নবীন সেনারা, পথনির্দেশকের ভূমিকায় জ্ঞানোদ্দীপক উপস্থাপন সেনাপ্রধানের
প্রকাশিতঃ 7:14 pm | December 04, 2023
কালের আলো রিপোর্ট:
তখন নবীন অফিসারদের মধ্যে যেন বয়ে যাচ্ছে অবারিত আনন্দের ফল্গুধারা। রঙবেরঙের বাহারি বেলুনে ছেয়ে গেছে আকাশ। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন আকাশছোঁয়ার চেষ্টা করছে নবীন সেনাদের টুপি। এই আনন্দ রীতিমতো বাঁধভাঙা। দীর্ঘ ৩ বছরের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ৮৫তম বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সের মোট ২৫০ জন অফিসার ক্যাডেট এবং এক বছরের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ৫৮তম বিএমএ স্পেশাল কোর্সের ৩ জন অফিসার ক্যাডেট এবং ৭ জন ট্রেইনি অফিসার কমিশন লাভ করেন। মেধার সঙ্গে নিরলস শ্রম, কঠোর অভিনিবেশ আর অসামান্য পেশাদারিত্বের মাধ্যমে প্রত্যেকে গড়ে তুলেছেন নিজেকে।
সোমবার (০৪ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিস্থ বিএমএ প্যারেড গ্রাউন্ডে বিএমএ’র ৮৫তম বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সের অফিসার ক্যাডেটদের কমিশনপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেধাবী নবীন সেনা কর্মকর্তাদের পথনির্দেশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। নিজের পেশাদারিত্বের গভীর নির্যাসে দূরদৃষ্টির পরিচয়বহ, দিকনির্দেশনামূলক এবং সুমিত ভাষায় জ্ঞানোদ্দীপক এক দীর্ঘ বক্তব্যই উপস্থাপন করলেন তিনি। অন্তরমথিত ভালোবাসায় সেই বক্তব্যে কালের বিবর্তনে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় শক্তিশালী ও সক্ষম সেনাবাহিনী, দেশপ্রেম ও সাহসিকতার সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, নিজ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য-বাদ যায়নি কোন কিছুই।
পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার নিরবচ্ছিন্ন চর্চার আলোকেই সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ সেনাবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় কর্তব্য, নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। এই সেনাবাহিনী একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ও দেশের মানুষের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।’
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে ২২৮ জন পুরুষ ও ৩১ জন মহিলা অফিসার রয়েছেন। এছাড়াও কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে ১ জন শ্রীলংকান অফিসার রয়েছেন যিনি নিজ সেনাবাহিনীতে যোগদান করবেন। সর্ব বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার এ এম সানজিদ ৮৫তম বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে সেরা চৌকস ক্যাডেট বিবেচিত হন এবং অসামান্য গৌরবমন্ডিত ‘সোর্ড অব অনার’ অর্জন করেন। এছাড়া কোম্পানি সিনিয়র আন্ডার অফিসার রিয়াদ হোসেন সামরিক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ‘সেনাবাহিনী প্রধান স্বর্ণপদক’ অর্জন করেন এবং অফিসার ক্যাডেট হারসা নিমেসা তিলান্থা হিথারচ্ছি বেস্ট ওভারসিজ ক্যাডেট এওয়ার্ড অর্জন করেন। পরে ক্যাডেটরা আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন এবং পিতা-মাতা ও অভিভাবকরা নবীন অফিসারদের র্যাংক-ব্যাজ পরিয়ে দেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান অতিথি সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বিএমএ প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছালে আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহম্মেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শাহিনুল হক ও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল এস এম কামরুল হাসান তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। পরে সেনাপ্রধান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও প্যারেডের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এরপর তিনি কৃতি ক্যাডেটদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন অনেক আধুনিক ও চৌকস একটি বাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ প্রশিক্ষণ শেষ করা ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ আজ এই শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তোমাদের উপর ন্যস্ত হলো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব।’ তিনি জাতির পিতার হাতে গড়া এই সেনাবাহিনীকে একটি প্রশিক্ষিত, সুশৃংখল এবং আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পূর্বের তুলনায় বর্তমানে অনেক আধুনিক ও চৌকস একটি বাহিনী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী এখন সুপ্রশিক্ষিত, দক্ষ ও সর্বদা প্রস্তুত। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বজায় রাখাসহ বিশ্ব পরিমণ্ডলে শান্তিরক্ষা করে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি ও প্রভূত সুনাম অর্জন করেছে।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ও ভূয়সি প্রশংসা অর্জন করেছে মন্তব্য করে সেনাপ্রধান আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি দক্ষ ও আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য। এই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই বঙ্গবন্ধু মিলিটারি একাডেমি আজ বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে ও বিদেশে বিশেষভাবে সমাদৃত। এই একাডেমি থেকে প্রশিক্ষিত অফিসারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।
নতুন অফিসারদের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সকলের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও সৌভাগ্যের বিষয়। বিশ্বমানের এই একাডেমিতে দীর্ঘ তিন বছর কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে আজ তোমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাঙ্খিত কমিশনের দ্বারপ্রান্তে। আমি নিশ্চিত আজকের এই দিনটি তোমাদের জীবনের একটি অনন্য স্মরণীয় দিন। তোমাদের জীবনের বিরল এই অর্জনের জন্য তোমাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।’
নবীনদের দিকনির্দেশনা দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে সবসময় তোমাদের কার্যকর নেতৃত্বের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সততা, কর্তব্য, নিষ্ঠা ও আনুগত্য দ্বারা তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করবে। এজন্য তোমাদের অধীনস্থ সৈনিকদের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে হবে। সহমর্মিতা দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ভ্রাতৃত্ববোধ, দলগত চেতনা ও মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমে অধীনস্থদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে তাদের পরিচালনা করার নিরন্তন চেষ্টা তোমাদের মধ্যে থাকতে হবে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিবে। মনে রাখবে, তোমাদের উপর অর্পিত হবে সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের গুরুদায়িত্ব। তোমাদের সেই নেতৃত্বের জন্য জানাই অভিনন্দন।’
জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আজকের যে অর্জন রয়েছে তাকে ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তোমাদের দায়িত্ব। তোমাদের নবীন নেতৃত্বের দৃপ্ত স্পৃহাই এই সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। আমার বিশ্বাস তোমরা যে ধরনের উন্নত ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছো তা তোমাদের ভবিষ্যতে দেশ ও সেনাবাহিনীর কল্যাণে সঠিক ও দূরদর্শি সিদ্ধান্ত গ্রহণে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলবে। আশা করি তোমরা গত দিনের চেয়ে ভালো করার প্রয়াস নিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে এবং নিজেদের জ্ঞান ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ করতে থাকবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তোমাদের নবীন নেতৃত্বে এবং সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জাতির গর্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সফল হবে।’
কালের আলো/এমএএএমকে