ইজতেমা: ছড়িয়ে পড়ুক সম্প্রীতির শিক্ষা

প্রকাশিতঃ 9:54 am | February 02, 2024

মাহমুদ আহমদ:

গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে আজ (শুক্রবার) শুরু হচ্ছে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে তাবলিগ জামাত ইজতেমা। ইজতেমার প্রথম পর্ব ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় পর্ব হবে ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি। তাবলিগ জামাতের সাম্প্রীতিক বিভাজনে বাংলাদেশের আপামর জনতা সবাই ব্যথিত। আমরা চাই বিভাদ ভুলে সম্প্রীতির বাধনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাওয়াতের কাজ করবে।

তাবলিগের শুভাকাঙ্খী, কর্মী, সঙ্গী ও দায়িত্বশীলগণের দ্বীনি দাওয়াতের মেহনত ও কর্মস্পৃহা বাড়াতেই ইজতেমার আয়োজন। ইসলামের সহজ-সরল ও যৌক্তিক বিধানগুলো মানুষের দোয়ারে পৌঁছে দেয়াই তাবলিগ। ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তাবলিগের প্রচার-প্রচারণা দিন দিন প্রসারিত হওয়া এবং তাবলিগের সাথী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০ বছরের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে বড় আয়োজনে ইজতেমা আয়োজন করা হয়।

তাবলিগের দুপক্ষের মাঝে দূরত্ব কমে সম্প্রীতির পরশে আবদ্ধ হবে এটা আমাদের প্রত্যাশা। আমরা যদি মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ এবং তিনি যেভাবে সমাজে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন তা প্রতিষ্ঠা করতে পারি তবেই হবে আমাদের সার্থকতা।

মহানবি (সা.) শান্তি, সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন এক মূর্ত প্রতীক। যুগ যুগ ধরে যারা বিকৃত ও ভ্রষ্ট তাদের উন্নত আচার-ব্যবহার শেখানোর জন্য আর সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা ঘুচানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবিকে (সা.) প্রেরণ করেছেন। কীভাবে নিজের প্রভুর ভালোবাসা অর্জন করা যায় আর তার সৃষ্টির প্রাপ্য অধিকার প্রদান করতে হবে মহানবি (সা.) তা শিখিয়েছেন। মহানবির উপদেশ দেয়ার রীতিও ছিল বিস্ময়কর। তার (সা.) প্রতি আল্লাহতায়ালার এই নির্দেশও ছিল, নিজ অনুসারীদের সাথে নম্রতা ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করবে। এ উদ্দেশ্যে তিনি (সা.) আপনজন অর্থাৎ ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন এবং শিশুদের বুঝানোর জন্য তাদের সাথেও কোমল, প্রীতিপূর্ণ ও স্নেহসূলভ ব্যবহার করেছেন আর উম্মতের অন্যদের সাথেও আর নিজের সাহাবীদের সাথেও। আর সর্বদা এই নির্দেশকে দৃষ্টিপটে রেখেছেন যে, তোমার কাজ হল, উপদেশ দেওয়া আর ধীরেসুস্থে বা প্রশান্তচিত্তে সুন্দরভাবে উপদেশ দিতে থাক।

মহানবির (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদীর লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদীর লাশ বিশ্বনবির (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো ইহুদীর লাশ। এতে আল্লাহর রাসুল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদীর লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথিদেরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবীর উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার করা?

বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহতায়াল মানবজাতির কল্যাণের জন্য শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। জনদরদী মহানবি (সা.) মানুষকে সকল প্রকার পঙ্কিলতা, অনিয়ম, অনাচার, পাপাচার ও অন্ধকারের বেড়াজাল হতে মুক্ত করতে আজীবন চেষ্টা চালিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন। অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছা না পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হন নাই। নিজে বহু কষ্ট করেছেন, নানা বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছেন, জীবনের ওপরে বার বার হুমকি এসেছে তবুও তিনি পিছিয়ে যান নি। একাধারে বিরামহীন চেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তিনি জয়যুক্ত হয়েছেন। এভাবে সেকালের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিশ্বনবি (সা.)কে আল্লাহতায়ালা কেবল মক্কা শহর বা সেই দেশ বা কেবল সেই যুগের লোকদের জন্যই আবির্ভূত করেননি। তিনি (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহানবির শিক্ষা কতই উন্নত ছিল যে, বল-প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত তিনি বারণ করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে তিনি (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলমান হলো সেই ব্যক্তি, যার হাত এবং জিহ্বা হতে অন্যেরা নিরাপদ থাকে’ (বোখারি-মুসলিম)। বস্তুত: ইসলামি শিক্ষা এক মুসলমানকে শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই শিক্ষা ভুলে পরস্পর হানাহানির নীতি কোনো ক্রমেই ইসলাম সমর্থন করে না-একথা অনেকেই বাস্তব ক্ষেত্রে বেমালুম ভুলে বসেছে। যদি আমার হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদ না থাকে তাহলে আমার কার্যে প্রমাণ করে যে আমি শান্তির দূত মহানবির (সা.) প্রকৃত অনুসারী নই।

মহানবির (সা.) পবিত্র জীবন পরমত সহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় ও বাকস্বাধীনতার অগণিত উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। ইসলামের চরম শত্রু ইকরামার ঘটনা দেখুন! যুদ্ধাপরাধের কারণে যাকে হত্যার নির্দেশ জারি হয়ে গিয়েছিল, তার স্ত্রী মহানবির (সা.) কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রত্যাশী হলে তিনি (সা.) একান্ত স্নেহপরবশ হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন। ইকরামার স্ত্রী তাকে নিয়ে মহানবির (সা.) সমীপে উপস্থিত হলে ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন? তিনি (সা.) বলেন, সত্যিই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ইকরামা জিজ্ঞেস করে, আমি যদি আমার ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকি তবুও? অর্থাৎ আমি যদি মুসলমান না হই তবুও? এই শিরক এর অবস্থায় আপনি আমাকে ক্ষমা করছেন কি? তখন তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। মহানবির (সা.) সুমহান ব্যবহার ও অনুগ্রহের এই নিদর্শন দেখে ইকরামা মুসলমান হয়ে যায়। (আস সিরাতুল হালবিয়্যাহ্, ৩য় খণ্ড, পৃ: ১০৯) ইসলাম এরূপ উত্তম চরিত্র এবং ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতা প্রদানের সুবাদে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তম ব্যবহার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার এই তীর এক নিমিষেই ইকরামার মত মানুষকেও ঘায়েল করে ফেলেছিল।

মহানবি (সা.) বন্দী এবং ক্রীতদাসদেরও এই সুযোগ প্রদান করেছিলেন, তোমরা যে ধর্ম চাও গ্রহণ করতে পারো। যেমন সুমামাহ বিন উসাল বনু হানীফার একজন প্রভাবশালী নেতা ছিল। এই লোক মহানবিকে (সা.) হত্যার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এরপর সাহাবীদের একটি দলকে সে ঘেরাও করে শহীদ করেছিল। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে মহানবির (সা.) সামনে নিয়ে আসা হলে তিনি (সা.) তাকে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার সাথে কি ব্যবহার করা হবে বলে তোমার মনে হয়। সে বলে, আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন রক্তপাতকারীকে হত্যা করবেন আর আপনি যদি কৃপা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তির প্রতি করুণা করবেন যে অনুগ্রহের মূল্য দিতে জানে। লাগাতার তিনদিন মহানবি (সা.) আসেন এবং সুমামাহর কাছে এই একই প্রশ্ন করতে থাকেন আর সুমামাহ্ও একই উত্তর দিতে থাকে। অবশেষে তৃতীয় দিন মহানবি (সা.) বলেন, ‘একে মুক্ত করে দাও’। এরপর সে মসজিদের নিকটে খেজুরের বাগানে যায় ও গোসল করে এবং মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে আর বলে, হে মুহাম্মদ (সা.) খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে অপছন্দনীয় ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা হল, আমার সবচেয়ে প্রিয় হল আপনার চেহারা। খোদার কসম! পৃথিবীতে আমার কাছে সবচেয়ে অপছন্দের ছিল আপনার ধর্ম কিন্তু বর্তমান অবস্থা হল, আমার প্রিয়তম ধর্ম হল আপনার আনীত ধর্ম। খোদার কসম! আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এই শহরটিই আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর। (বোখারি)

মহানবির (সা.) মাধ্যমে বিশ্বের জাতিসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়েছে। কারণ পূর্বে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহতায়ালার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। মহানবি (সা.) নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি (সা.) বলেছেন ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সকলের জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)।

বিভেদ ভুলে ইজতেমার ময়দান থেকে মহানবির (সা.) সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ুবে প্রতিটি হৃদয়ে। বিশ্ব ইজতেমা শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে অনুষ্ঠিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।