অপহরণ চক্রের হয়ে কাজ করছেন গাড়িচালকরা, ডিবির সতর্কতা
প্রকাশিতঃ 6:51 pm | February 03, 2024
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
রাজধানীর উত্তরা থেকে শেরপুর যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান হিমেল। দীর্ঘ এক মাস তাকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার হুমকি দিয়ে কয়েক কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে আসছিলো একটি চক্র। সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সুনামগঞ্জের তাহিপুরের দুর্গম পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয় হিমেলকে। গ্রেপ্তার করা হয় অপহরণ চক্রের মূলহোতাসহ ১২ জনকে।
হিমেল অপহরণের ঘটনায় তদন্তে নেমে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পেরেছে এই অপহরণের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন ব্যক্তিগত গাড়িচালক সামিদুল। এমন কি বিভিন্ন অপহরণ চক্রের সঙ্গে গাড়ি চালকদের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ। আর তাই নাগরিকদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটটি।
শনিবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)’র অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিমেল অপহরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) লালবাগ বিভাগ তদন্ত করছিলো। এই মামলার তদন্তে হিমেলের ব্যক্তিগত গাড়ির চালককে গ্রেপ্তার করা হয়। এই চালকই কিন্তু অপহরণের মূলহোতা। চালক সামিদুল ইসলাম যখন গাড়ি চালাতেন তখন তার ভেতরে লোভ জাগে তার স্যারের মতো নিজের একটি গাড়ি থাকবে। হিমেলের অনেক টাকা। তার বাবা মারা গেছে। মায়ের একমাত্র সন্তান। হিমেলের টাকা তারও হবে এই ভাবনা থেকে অপহরণের পরিকল্পনা শুরু হয়।
ডিবি জানায়, সামিদুল প্রথমে তুরাগ এলাকার হানিফ বাবুর্চী নামের এক সাইটের ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর পরবর্তী আলোচনা হয় ময়মনসিংহের দোবাউরা থানার ইউপি চেয়ারম্যান মামুনের সঙ্গে। তিনি একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। হিমেলকে অপহরণ করে তার বাসায় রাখার পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে হিমেলকে অপহরণ করে তার বাসায় নেওয়া হয়। কিন্তু টাকা পেতে দেরি হওয়ায় মামুন গাড়ি দিয়ে বর্ডার এলাকায় হিমেলকে পাঠানো হয়। গাড়িতে করে হিমেলকে বর্ডারের একটি পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সামিদুল ও মালেক, মোবারক, মানিককে নিয়ে চলে যান। তখন থেকেই হিমেলের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। পরবর্তীতে ডিবি লালবাগ বিভাগ কাজ শুরু করে। তদন্তে নেমে ডিবি লালবাগ শরীয়তপুরের চর অঞ্চল থেকে মাসুদ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। মাসুদের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ময়মনসিংহের দোবাউরা, নেত্রেকোনা, দূর্গাপুর এরপর তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরে সোর্স নিয়োগ করা হয়। এই সোর্সের মাধ্যমে ডিবি জানতে পারে এই গ্রুপটা শুধু অপহরণ করে না তারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তারা গরু, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে তারা অপহরণের পর ভুক্তভোগীকে নির্যাতন শুরু করে। যার ছবি ও ভিডিও পাঠানো হত হিমেলের মায়ের কাছে। সর্বশেষ তারা ৩০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু এরমধ্যে ডিবির চতুর্দিক থেকে সাঁড়াশি অভিযানের কারণে তারা পেরে উঠতে পারেনি। এই সময়ে অপহরণকারীদেরও টাকা শেষ হয়ে গেছিল। কারণ ওপারের মেঘালয় পুলিশ ও এপাড়ে আমাদের তৎপরতার ফলে এক মাস পাহাড়ে থাকায় টাকা শেষ হয়ে গেছিলো। এই সময়ে তারা টাকার যোগান দিতে গরু চুরি করে বিক্রি করে। এরপর সেই টাকা দিয়ে পাহাড়ে অবস্থান করত। পরে আমরা খবর পেলাম অপহরণকারীরা টাঙ্গুয়ার হাওরে আবারও অন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে। এমন খবর পেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি নৌকা থেকে হিমেলের গাড়ি চালক সামিদুল, ১৭ মামলার আসামি মালেকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই অভিযানে র্যাবও সহযোগিতা করেছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, তাদের গ্রেপ্তারের পর আমরা তথ্য পাই এই অপহরণের মূল পরিকল্পনা করা হয় তুরাগ থানায়। এরপর ধোবাউরায় ইউপি চেয়ারম্যানের বাসায় বসে পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্ব ঠিক করা হয়। এই ঘটনায় মামুন ও হানিফ এই ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
ডিবিপ্রধান বলেন, আমাদের কাছে তারা স্বীকার করেছে তারা একাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। ভুক্তভোগীরা নানা কারণে তাদের টাকা দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনায় ডিবি পুলিশ নিয়মিত মোবাইল ট্রাকিংসহ বিভিন্নভাবে কাজ করেছে গেছে। পাশাপাশি মেঘালয় পুলিশের তৎপরতার কারণে তারা যে দুই তিন কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল সেটি নিতে তারা ব্যর্থ হয় এবং আমরা ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়।
গাড়ি চালকরা অহরণের চক্রের হয়ে কাজ করছে উল্লেখ করে গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা বলবো যারা ব্যক্তিগত গাড়িচালক নিয়োগ করেন, নিয়োগ করার আগে সতর্ক হতে হবে। কারণ এই ঘটনায় আমরা সামিদুলের মাধ্যমে দেছেছি তার মতো বহু চালক এই সকল অপহরণ চক্র ও সন্ত্রাসীদের কাছে তথ্য দিয়ে থাকে। গাড়ি চালকরা পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে। এই সকল তথ্যের কারণেই অনেক ঘটনা ঘটছে। সব তো আর আমাদের কাছে আসে না।
‘অনেকে টাকা পয়সা দিয়ে মীমাংসা করে। কিন্তু হিমেলের মা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করায় এটা সম্ভব হয়েছে। আমরা মনে করি এই চক্রের সকল সদস্যকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। গোয়েন্দা পুলিশ সাতজন ও র্যাব পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।’
হিমেলকে সীমান্তে কী উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানতে চাইলে গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, আমাদেরও একটাই প্রশ্ন। যেখানে আমরা যেতে পারি না। কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওর, কলমাকান্তা, দূর্গাপুর, মেঘালয় এই সকল এলাকায় আমরা যেতে পারি না। কিন্তু সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে, চোরাকারবারিদের নিয়মিত যাতায়াত হচ্ছে। দুই দেশের সিম অবাধে বিক্রি হচ্ছে। গরু, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এই মানুষগুলো কীভাবে যাচ্ছে। তাই এখন এই সকল অঞ্চলে আমাদের নিয়মিত নজর রাখতে হবে। তবে আমরা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িতদের নাম পরিচয় পেয়েছি। যারা অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের অনেককে গ্রেপ্তার করেছি। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছি। আমাদের ডিবি এখনও কাজ করছে। আর যারা বর্ডার এলাকায় কাজ করছে তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে।
গাড়ি চালকদের টার্গেট করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে হারুন বলেন, কেউ চাইলে তো কোনো ব্যক্তির তথ্য সহজে সংগ্রহ করতে পারে না। বড়লোকের সন্তান বা পরিবারের সন্তানকে অপহরণ করতে চায় তখন তারা গাড়ি চালকদের ব্যবহার করে গুরত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে। হিমেলের ক্ষেত্রেও অপহরণকারী চক্রটি গাড়ি চলক সামিদুলকে টার্গেট করে। আর সামিদুলেরও টার্গেট ছিলো বড় লোক হওয়ার। তাই তারা সহজে তাকে ব্যবহার করতে পেরেছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেঘালয়ের কেউ জড়িত আছে কি না সেটা জানতে আমরা তদন্ত করছি। আমার বেশ কিছু নাম ও নাম্বার পেয়েছি। যেহেতু অপহরণকারীরা মেঘলয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তার মানে ওপারের কেউ না কেউ তো জড়িত আছে।
কালের আলো/ডিএস/এমএম