ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির ঈদ

প্রকাশিতঃ 6:19 pm | April 12, 2024

মাহমুদ আহমদ:

একমাস সিয়াম সাধনার পর আজ আমরা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করছি, আলহামদুলিল্লাহ। অনাবিল আনন্দ ও উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় এ ঈদুল ফিতর। এ ঈদ মুসলমানদের জাতীয় উৎসব। বিশ্ববাসীর মাঝে যে আনন্দ বার বার ফিরে আসে তাকেই ঈদ বলা হয়।

মুসলিম জাহান সিয়াম-সাধনা এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে অতীতের ভুল-ভ্রান্তির ক্ষমা চেয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার অঙ্গীকারে প্রত্যয়ী হওয়ার এক সফল অনুষ্ঠান এ পবিত্র ঈদ। বর্তমান ঈদকে কেবল ধর্মীয় কিংবা সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বরং ঈদ আজ সার্বজনীন আনন্দের নাম। সামাজিক উৎসবগুলোয় আমরা যেমন আনন্দে মাতি, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছে বিশেষ কিছু উৎসবমুখর দিন। সেই উৎসবগুলোও আমাদের আনন্দে ভাসায়। ব্যবধান ঘুচিয়ে এক করে। আমাদের বাংলাদেশেও রয়েছে নানা ধর্ম, গোত্রের মানুষের বাস। ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা, বৈসাবি, রাস পূর্ণিমা প্রভৃতি বিশেষ দিনে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। এসব ধর্মীয় উৎসব বৃহৎ অর্থে সামাজিক জীবনাচারেরই অনুষঙ্গ। এসব উৎসব উদযাপিত হয় সমাজের মধ্যেই। প্রতিটি উৎসব আমাদেরকে একতা, ঐক্য, বড় ও মহৎ হতে শেখায়। ঈদের আনন্দে দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সাথে ভাগ করার মাঝেই সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ।

ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দেয়। এভাবে ঈদুল ফিতরের উৎসব ইসলামী জীবন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি বিশ্বজনীন নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। এ আনন্দের দিনে প্রতিটি মুসলিম তার সামাজিক অবস্থান ভুলে যায় এবং ভ্রাতৃত্ববোধের পর তৃপ্তিতে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। পার্থক্য থাকে না ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সবল-দুর্বল, বংশ গৌরব, কৌলিন্য ও মান-মর্যাদা। ঈদগাহে সারিবদ্ধভাবে জামাতের সঙ্গে ঈদুুল ফিতরের দু’ই রাকাত ওয়াজিব নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষেই সাম্যের অতুলনীয় বাস্তব দৃশ্যের চিত্র ফুটে ওঠে।

মুসলমানের জন্য ঈদ একটি মহা ইবাদতও। ঈদের ইবাদতে শরীয়ত নির্দেশিত কিছু বিধি-বিধান রয়েছে, যা পালনে সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও বন্ধন সুসংহত হয়। ঈদুল ফিতরের শরীয়ত দিক হলো, ঈদের নামাযের পূর্বে রোযার ফিতরানা ও ফিদিয়া আদায় করা, ঈদ গাহে দু’ রাকাত নামায আদায় করা, খুতবা শুনা এবং উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা। ঈদে আমাদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটে আর পরস্পরের মাঝে ঈমানী ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের মাঝে হিংসা বিদ্বেষ দূর হয়ে এক স্বগীর্য় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যদি এমনটা হয় তাহলেই আমাদের এ ঈদ পালন ইবাদতে গণ্য হবে।সুনানে ইব্ন মাজাহ গ্রন্থে ঈদের ফজিলত সম্পর্কে এসেছে, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদত করবে তার অন্তরকে আল্লাহতায়ালা রহমত ও বরকতের বারিধারা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঈদের দিন আল্লাহ তা’লা ফেরেশতাদের বলেন, তারা আমার ফরজ আদায় করে প্রার্থনার জন্য বের হয়েছে। আমার মর্যাদা বড়ত্ব ও সম্মানের কসম! আমি অবশ্যই তাদের প্রার্থনা কবুল করবো। তারপর আল্লাহ বান্দাদের উদ্দেশ করে বলেন, ফিরে যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাদের পাপগুলোকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছি। এরপর সবাই ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। (বায়হাকির সূত্রে মেশকাত, অধ্যায়: হায়াতুল মুসলিমিন, পৃ: ২৪৯)।

ঈদের উৎসবে একটু আনন্দের মধ্যে থাকা, খেলাধুলা করা বা উপভোগ করার শিক্ষা আমরা নবীজির জীবন থেকে পাই। আয়েশা (রা.) বলেন, এক ঈদের দিন হজরত আবু বকর (রা.) আমার ঘরে এলেন। সেখানে তখন দু’জন মেয়ে বুআস যুদ্ধের গান গাইছিল। তারা গায়িকা ছিল না। হজরত আবু বকর (রা.) ওই মেয়ে দুটোকে শক্ত ধমক দিয়ে বললেন, শয়তানি বাদ্য! তাও রাসুলের ঘরে! রাসুল (সা.) বললেন, আবু বকর! ওদের ছেড়ে দাও। প্রতিটি জাতিরই ঈদ ও খুশির দিন থাকে। আজ আমাদের ঈদের দিন। (সহিহ বুখারি)।

আল্লাহ্ তা’লার আদেশে এক মাস রোজা রাখার পর তার আদেশেই আমরা ঈদের আনন্দ উদযাপন করি। এক মাস রোজা আমরা আমাদের তাকওয়াকে ও ঈমানকে বাড়ানোর জন্য রেখেছি। আমরা রমজানের রোজা এজন্যই রেখেছি, যেন আল্লাহপাকের নৈকট্য অর্জনকারী হতে পারি। এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন ঈদ উদযাপন করার। প্রত্যেক বৈধ কাজ যা থেকে তিনি আমাদেরকে এক নির্ধারিত সময় বিরত রেখেছিলেন আজ ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে তা করার অনুমতি দিয়েছেন।

ঈদ উদযাপন মূলত আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আর কৃতজ্ঞতার সর্বোত্তম পন্থা হলো, ধনী-গরীব সবাই একত্রিত হয়ে ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করা। একমাস রোজা রাখার যে তৌফিক আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন এরই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এ দুই রাকাত নামাজ। তাই বলা যায়, ঈদ কেবল ভাল খাওয়ার বা ভাল পরার আর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ ভ্রমণ করার নাম নয় বরং কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য একটা বিশেষ সুযোগ হিসেবে আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে ঈদ দান করেছেন।

ঈদের এই আনন্দ তখনই সার্বজনীন রূপ লাভ করতে পারে যখন সমাজ ও দেশের সবাই একত্রে আনন্দের ভাগী হব। আমাদের সন্তানদেরকেও ঈদে গরীবদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের শিক্ষা দিতে হবে। ঈদের যে উপহার তাদেরকে দেয়া হয়, তা থেকে যেন তারা একটা অংশ গরীবদের জন্য পৃথক করে নেয়। তারা যেন শুধু নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতিই খেয়াল না রাখে, নিজেরাই যেন ভাল খাবার ইত্যাদি না খায় বরং গরীব, অসহায় যারা রয়েছে তাদের প্রতিও যেন খেয়াল রাখে। এ শিক্ষা আমাদের প্রত্যেক অভিভাবককে দিতে হবে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন ইসলামি ঐতিহ্যের জয়গান গেয়েছেন, অপর দিকে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার ঈদের আনন্দকে সার্বজনীন হিসেবে তুলে ধরার জন্য লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় তিনি তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন এভাবে- শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি ধারা ঝরায়ে গো/বরষের পর আসিলে ঈদ!/ভুখারির দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের/কন্টক-বনে আশ্বাস এনে গুলবাগের…/আজি ইসলামের ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান/নাই বড় ছোট-সকল মানুষ এক সমান/রাজা প্রজা নয় কারো কেহ-তিনি ইসলামি সাম্যবাদী চেতনাকে সর্বজনীন রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায়। তার ‘নতুন চাঁদ’ কবিতায়ও বিষয়টি এভাবে ব্যক্ত করেছেন- সাম্যের রাহে আল্লাহর/মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের…/রবে না ধর্ম জাতির ভেদ/রবে না আত্ম-কলহ ক্লেদ। এরপর ‘কৃষকের ঈদ’ পঙক্তিতে তিনি লিখেছেন- জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে যায়, এক কাতারে সবাই নামাজ আদায় করি, সবার সাথে হাসি মুখে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করি, ঠিক তেমনিভাবে সারাবছর একই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে আর বিভেদের সকল দেয়ালকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কবি গোলাম মোস্তফা কতই চমৎকারভাবে তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন- ‘আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে, আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে, এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য, শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।’

পবিত্র ঈদুল ফিতর সবার মাঝে ভ্রাতৃত্বের মেল বন্ধন রচিত হবে-এটাই প্রত্যাশা। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।