জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবার সেরা বাংলাদেশ
প্রকাশিতঃ 12:16 am | May 29, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর :
সময়টি ১৯৮৮ সালের ১৪ আগস্ট। কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি যাত্রীবাহী বিমানে একে একে উঠলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ কর্মকর্তা। ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ (ইউনিমগ) নামে জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষা মিশনে সেই কর্মকর্তাদের নিয়ে বহনকারী বিমানটি ডানা মিললো ঢাকার আকাশে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে শান্তি অন্বেষণে নতুন দিকের সূচনা করলো লাল-সবুজের বাংলাদেশ। এরপর দেখতে দেখতে কেটেছে ৩৬ বসন্ত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন নামে এক নতুন অধ্যায়ের শুরুর পরের ইতিহাসটি গর্বের, মাথা উঁচু করে পথচলার।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ ৬৩টি মিশনেই অংশ নিয়েছে। সময়ের বহমানতায় অপরিহার্য করে তুলেছে নিজেদের। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ১৯৮৯ সাল থেকে পুলিশ বাহিনী এবং ১৯৯৩ সাল থেকে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে আসছে। ব্লু হেলমেটধারীরা এখন মিশনে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে ধরে রেখেছে শীর্ষ স্থান। দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সবার সেরা এই শান্তির প্রহরীরা। জাতিসংঘের পতাকাকে সমুন্নত ও উড্ডীন রাখার পাশাপাশি তাঁরা উজ্জ্বল করেছেন দেশের ভাবমূর্তি।
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আজ বুধবার (২৯ মে) আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হবে বাংলাদেশে। শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ একটি নির্ভরযোগ্য নাম বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিরক্ষীরা সংঘাত প্রতিরোধ, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করায় বরাবরই তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন সরকারপ্রধান। বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও বিপজ্জনক অঞ্চলে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বদা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা যাতে আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে সেজন্য তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথাও জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ‘মজ্জা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গত ৩৬ বছর যাবত শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠেছে দেশটি। বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে নিজেদের। অসামান্য অবদানের জন্য সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে এক নম্বরে অবস্থান করে নিয়েছে ব্লু-হেলমেটধারীরা।
# গর্বের, মাথা উঁচু করে পথচলার ৩৬ বছরের ইতিহাস
# সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষে
# সমুন্নত রেখেছেন জাতিসংঘের পতাকাকে
# উজ্জ্বল করেছেন দেশের ভাবমূর্তি
# শান্তি ও নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্ভরযোগ্য নাম বাংলাদেশ
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, দীর্ঘ চার দশকের শান্তিরক্ষার ইতিহাসে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের ৪৩টি দেশ ও স্থানে, ৬৩টি জাতিসংঘ মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ১৩টি দেশে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৯২ জন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ও কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছেন ৪৯৩ জন নারী শান্তিরক্ষী। শুরু থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সর্বমোট ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন।
শান্তিরক্ষীদের প্রশংসনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নির্দেশনা
বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের এমন প্রশংসনীয় দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নির্দেশনা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বকে সব সময় দৃঢ়চিত্তে উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। বুধবার (২৯ মে) আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসের বাণীতে তিনি বলেছেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আজকের এই গৌরবময় অর্জনের পেছনে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ও সুদৃঢ় নেতৃত্ব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ফোর্সেস গোল-২০৩০ অনুযায়ী শান্তিরক্ষা মিশনের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি সংযোজন করা হয়েছে। সম্প্রতি শান্তিরক্ষা মিশনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তিনটি হেলিকপ্টার ডিআর কঙ্গোতে মোতায়েন করেছে, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি নতুন মাইলফলক। পাশাপাশি, সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য পেরুর সশস্ত্র বাহিনীকে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়কারী যান (রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল) প্রদান করা হয়েছে-যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করেছে। আমাদের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি নারী সদস্যরাও এখন পূর্বের তুলনায় অধিকহারে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের গ্রহণযোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সার্বিকভাবে সুপ্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ সেনাসদস্য, উন্নত সরঞ্জাম, বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং উন্নত মূল্যবোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিশন এলাকার জনসাধারণ ও জাতিসংঘের আস্থা অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।’
জানা যায়, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা দেশসমূহ সফর করেন। সেখানে তিনি সাধারণ সৈনিক থেকে শুরু করে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলার বিষয়টিতেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এসবের সুফল হিসেবেই আবারও সৈন্য প্রেরণের দিক থেকে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
সেসব দেশের মানুষের মনেও শ্রদ্ধার আসনে ব্লু হেলমেটধারীরা
অতীতের ধারাবাহিকতায় এই সময়েও সর্বোচ্চমানের পেশাদারি মনোভাব, সাহসিকতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাস, সংঘাত ও দাঙ্গা দমনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন থেকে শুরু করে দেশ পুনর্গঠনে নির্ভীক ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। এক সময় যেসব দেশের সাধারণ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ নামের সঙ্গেই পরিচিত ছিল না সেসব দেশের মানুষের মনেও শ্রদ্ধার আসন নিয়েছে বাংলাদেশ। দেশগুলোতে ব্লু হেলমেটধারীরা বিশ্বমানবতার সেবায় উৎসর্গ করেছেন নিজেদের। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতায় তাঁরা আজ ওই সব দেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত।
নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে তাঁর বাণীতে বলেন, ‘বিশ্ব শান্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম শান্তিরক্ষী মোতায়েনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তার যাত্রা শুরু করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ দিকনির্দেশনায় ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দু’টি যুদ্ধজাহাজের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন লেবানন এ যোগদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা এবং ভাবমূর্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ‘বানৌজা সংগ্রাম’ ভূ-মধ্যসাগরে মেরিটাইম টাস্ক ফোর্সের অংশ হিসেবে লেবাননে অবৈধ অস্ত্র এবং গোলাবারুদের অনুপ্রবেশ রোধ, দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজ উদ্ধার তৎপরতাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল কার্যক্রম পালনে নিয়োজিত রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি নৌ কন্টিনজেন্ট ২০১৫ সাল থেকে দক্ষিণ সুদানে ‘বাংলাদেশ ফোর্স মেরিন ইউনিট (বিএএনএফএমইউ) হিসেবে মোতায়েন রয়েছে। কন্টিনজেন্টটি জাতিসংঘের নিত্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য-সামগ্রী, ঔষধ ও মানবিক সাহায্য বহনকারী নৌযানসমূহের নদীপথে নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তাসহ স্থানীয় জনগণকে জরুরি চিকিৎসা প্রদান, মিশনে নিয়োজিত সামরিক এবং অসামরিক সদস্যদের প্রয়োজনীয় রসদ সামগ্রী পরিবহনে সহায়তা করে আসছে।’
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নি:স্বার্থ আত্মত্যাগ জাতিসংঘের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত বছর আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হওয়ার সময়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেই সময় দিবসটির বাণীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি যে গণহত্যা, নিপীড়ন, দুর্ভোগ, বাস্তুচ্যুতি, নির্যাতন এবং মানবিক সংকটের ভয়াবহতা দেখেছে তার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশকে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর দুর্দশার উন্নয়নে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ শান্তি ও সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বর্তমান প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসে তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী, দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের সুনাম আজ সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের উন্নত পেশাদারিত্ব, অসীম সাহসিকতা এবং অনবদ্য অবদানের বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিশ্ব বরেণ্য নেতৃবৃন্দের ভূয়সী প্রশংসা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌছে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষায় সুদীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতিসংঘের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে।’
কালের আলো/এমএএএমকে