প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর তিন সমুদ্রবন্দর

প্রকাশিতঃ 11:38 pm | July 28, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

সম্প্রতি আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য ও কারফিউর কারণে স্থবির থাকার পর আবারও আগের মতোই কর্মব্যস্ততা আর প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে ওঠেছে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হওয়ায় স্বাভাবিক হয়েছে বন্দর ও কাস্টমসের কার্যক্রম। আমদানি-রপ্তানি নতুন চালান শুল্কায়নের মাধ্যমে পণ্য খালাস ও রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ শুরু হয়েছে। সড়কের পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ইতোমধ্যেই খালাস পণ্য নির্ধারিত স্থানগুলোতে নিতে শুরু করেছেন আমদানিকারকরা। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই তিনটি সমুদ্র বন্দরই তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন। পাশাপাশি বন্দরসমূহের নিরাপত্তায় সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থান দ্রুতই পরিস্থিতি উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বড় ধরণের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।

জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি। তিনি বন্দরে কর্মরত ৬ হাজার ৭০০ শ্রমিকের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। সেদিন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের অচলাবস্থায়ও চট্টগ্রাম বন্দর থেমে থাকেনি। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডেলিং ঠিকভাবে হওয়ায় এখানে একটা কনটেইনারের উপরে চারটা-পাঁচটা করে কনটেইনার বসানো হয়েছে। এ দুর্যোগের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর সাত আট হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করেছে। কিন্তু সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেরিয়ে যেতে পারেনি। কারণ আমাদের কাস্টমস পুরোপুরি ডিজিটাল ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সব কনটেইনার জট লেগে গেছে। করোনাকালে আমরা বিভিন্ন অফ ডকে কনটেইনার রেখে কাস্টমসের সহযোগিতায় সবগুলো রিলিজ করেছিলাম। আশা করি, এবারও আমরা সবার সহযোগিতা পাবো।’

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র, বঙ্গবন্ধু টানেল, ইস্টার্ন রিফাইনারি, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েল কোম্পানিসহ উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে নৌবাহিনী। এসব কার্যক্রম সরেজমিন দেখতে গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শনে যান নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। পরদিন বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) একইভাবে তিনি মোংলা বন্দর পরিদর্শন করেন। সকল বন্দরের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নিজেদের সতর্ক অবস্থানের কথা জানান নৌবিহিনী প্রধান।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি বেড়েছে। শত শত ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও ট্রেইলার পণ্য নিতে বন্দরে প্রবেশ করছে। মাল বোঝাই করে এগুলো চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, আমদানি-রপ্তানি পণ্য জমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসে কাজের চাপ বেড়েছে। জমে যাওয়া কনটেইনার ডেলিভারি দিতে দিতে জাহাজ থেকে নামছে আরও নতুন পণ্যের চালান। গত কয়েক দিনের অচলাবস্থার কারণে বন্দরের ভেতরে আমদানি পণ্যের স্তূপ বেড়ে গিয়েছিল। খালাস না হওয়ায় প্রায় ৪১ হাজার কনটেইনারের স্তূপ জমে বন্দরে। পণ্য খালাস শুরু হওয়ায় এ সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। পণ্য খালাসের চাপের কারণে বন্দরের ভেতরে যান চলাচলে জট লেগে গেছে। এই চাপ স্বাভাবিক হতে কিছুদিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম সোহায়েল বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বন্দরের সবগুলো জেটিতে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামার কাজ স্বাভাবিকই ছিল৷ কিন্তু ডেলিভারিতে সমস্যা হয়ে যায়। সে কারণে বন্দরে থাকা কন্টেইনারের সংখ্যা বেড়ে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ায় এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাস্টমসে কিছু পণ্যের শুল্কায়ন ম্যানুয়ালি করতে শুরু করায় অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু পুরো স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে আরও কিছু দিন সময় লাগতে পারে।’

মোংলা সমুদ্র বন্দর
খালাসকরা পণ্য নির্ধারিত স্থানগুলোতে নিতে শুরু করেছেন আমদানিকারকরা। গত পাঁচ দিনে বিদেশ থেকে মোংলা বন্দরে ১৩টি জাহাজে করে প্রায় ৯৪ হাজার মেট্রিক টন ক্লিংকার, খাদ্যশস্য, পাথর বন্দরে খালাস হয়। কিন্তু সড়কে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল না করার তা নির্ধারিত স্থানে নিতে পারেনি আমদানিকারকরা। গত বুধবার থেকে এসব পণ্য সড়কপথে নিজ গন্তব্যে নেওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে নৌপথেও খালাস পণ্য নেওয়া হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে যেসব জাহাজ ক্লিংকার ও খাদ্যশস্য নিয়ে বন্দরে এসেছিল তা কনটেইনারবাহী ছিল না। ফলে সেগুলো কোনো পণ্য না নিয়ে ফিরে গেলেও রপ্তানি কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেনি।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শাহীন রহমান বলেন, ‘বন্দরের কার্যক্রম এখন স্বাভাবিক। দাপ্তরিক সব কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। নিরাপত্তার জন্য বন্দরের জেটি ও বন্দরের সদর দপ্তরের সামনে নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বন্দর জেটিতে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ রাখা আছে। এ ছাড়া কোস্টকার্ডসহ বন্দরের নিজস্ব বাহিনী টহলে আছে।’

পায়রা সমুদ্র বন্দর
পায়রা বন্দরের দাপ্তরিক সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন পায়রা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল আব্দুল্লাহ আল-মামুন চৌধুরীর নেতৃত্বে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত পায়রা বন্দরের জেটিতে ভিড়েছে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লাবাহী ৪টি মাদার ভেসেল। এর মধ্যে ১৫ জুলাই ওয়ান ব্রাইট ২৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা, ১৯ জুলাই সি স্প্রিট ২৪ হাজার মেট্রিক টন ও সর্বশেষ ২০ জুলাই এম ভি আবদুল্লাহ ২৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে নোঙর করেছে বন্দরের জেটিতে। পর্যায়ক্রমে এসব জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করা হয় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এমনকি এমভি আবদুল্লাহ মাদার ভেসেল কয়লা খালাস করে বন্দর ছেড়ে গন্তব্যে চলে গেছে। এছাড়াও মোট ৩১টি লাইটার জাহাজে বিভিন্ন পণ্য হ্যান্ডেলিং করা হয়েছে। মোট ১ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আসছে বন্দরে। এর মধ্যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ লাখ টন কয়লা রয়েছে। শুধু তাই নয় পটুয়াখালীতে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে মাদার ভেসেল এসেছে পায়রা বন্দরে। জাহাজ ৪টি কয়লা খালাস করে আবার ফিরে গেছে।

পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আব্দুল্লাহ আল-মামুন চৌধুরী বলেন, কারফিউয়ের মধ্যেও বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। শ্রমিকদের নিরাপত্তাসহ বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় বন্দরের ৩১ জন নিরাপত্তাকর্মী, ৪৮ জন আনসার সদস্য এবং নৌবাহিনীর ৪২ জন সদস্য কাজ করছেন। বন্দর সচল রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ কারণে এখন পর্যন্ত পায়রা সমুদ্র বন্দরকে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি বলেও জানান তিনি।

কালের আলো/এমএএএমকে