অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এবার শুরু হচ্ছে যৌথ অভিযান, পরিচয় দিয়ে গ্রেফতারের বার্তা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
প্রকাশিতঃ 10:08 pm | September 01, 2024
রাইসুল ইসলাম খান/ইয়াছিন আরাফাত:
ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনার সময় থানায় সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় আক্রমণকারীরা। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম। আরও বহু অস্ত্র বাইরে রয়ে গেছে। সেসব অস্ত্র এবং আগে থেকে অনেকের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এবার যৌথ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আগামী বুধবার (০৪ সেপ্টেম্বর) থেকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের সংস্কারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরুর বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই সময় উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে। বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
- অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এবার শুরু হচ্ছে যৌথ অভিযান
- শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক থানা ও ফাঁড়ির অস্ত্রাগার লুট
- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে মামলা
- সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি
- আওয়ামী লীগের শাসনামলে বৈধ অস্ত্রের মারাত্মক অবৈধ ব্যবহার
রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘কোনো অভিযান পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করতে হবে। পরিচয় না দিয়ে কোন অবস্থাতেই কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।’
জানা যায়, ক’দিন আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও থানা থেকে লুট হওয়া এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোনো ব্যক্তির কাছে রক্ষিত থাকলে আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দিতে বলা হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আগেই ঘোষনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানান, যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এর লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে, তা আগামী মঙ্গলবার (০৩ সেপ্টেম্বর) এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হবে, অন্যথায় তা অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ হিসেবে গণ্য হবে।
‘কোনো অভিযান পরিচালনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করতে হবে। পরিচয় না দিয়ে কোন অবস্থাতেই কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।’
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক ঘোষণায় ‘২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া সকল ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে। একই সঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল বৈধ লাইসেন্স গ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানার থানায় অথবা বর্তমান বসবাসের ঠিকানার নিকটস্থ থানায় লাইসেন্স গ্রহীতা নিজে বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে, বর্তমানে দেশে কত বৈধ অস্ত্র আছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি। এসব অস্ত্রের মধ্যে পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার ২ হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল ১ হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪ হাজার ৬টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা।
প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্রের মারাত্মক অবৈধ ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকেরা বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেন। কখনও কখনও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে পরে সেটিকে বৈধ অস্ত্র বলে দাবির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ সময়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া গত ৫ আগস্ট ও পূর্ববর্তী সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৈধ অস্ত্র নিয়ে মহড়া ও প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায়।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে মামলা
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলে আগামী বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা ও অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ/হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক-৪ শাখার উপ-সচিব মো: আরিফ-উজ-জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে৷
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ থেকে স্থগিত করা লাইসেন্সের অধীন থানায় জমা না করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী/সংস্থার বেহাত/হারানো অস্ত্রসহ যেকোনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনার নিমিত্ত নিম্নোক্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এতে জানানো হয়েছে, স্থগিতকৃত লাইসেন্সের তালিকা প্রণয়নপূর্বক সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স গ্রহীতাকে এসএমএসের মাধ্যমে লাইসেন্স স্থগিত এবং স্থগিতকৃত লাইসেন্সের অনুকূলে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে থানায় জমা প্রদানের বিষয়টি অবহিতকরণ।
এতে আরও বলা হয়েছে, বর্ণিত লাইসেন্স স্থগিত ও সংশ্লিষ্ট অস্ত্র-গোলাবারুদ থানায় জমা প্রদান এবং ৪ সেপ্টেম্বর হতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা ও অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ/হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ৷
এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ আগামী ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে কোর কমিটির সভা করবেন। সভায় স্থগিতকৃত লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনা করবেন। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ হতে কার্যকর অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব, আনসার সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন টিম গঠন করে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন৷
এতে আরও বলা হয়েছে, মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনারগণ সংশ্লিষ্ট সকল বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আগামী ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ হতে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যৌথ অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক প্রণীত স্থগিতকৃত লাইসেন্সধারীদের তালিকা এবং নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত জমাকৃত অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তালিকা ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে এ বিভাগে প্রেরণ করবেন।
কালের আলো/আরআই/ওয়াইএ/এমএএএমকে