কূটনৈতিক দেনদরবারে ‘মাছের রাজা’ ইলিশ

প্রকাশিতঃ 11:38 pm | September 22, 2024

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:

‘মাছের রাজা’ ইলিশ পছন্দ করে না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার! ইলিশের কথা ভাবতেই অনেকের জিভে পানি এসে যায়। স্বভাবতই খাদ্য উপাদানের বিরাট এই পুষ্টি ভাণ্ডার নিয়ে চিঠি চালাচালিও বড় বার্তা হিসেবে বিবেচ্য। আবার, ভূরাজনীতি বা কূটনীতির দেনদরবারে ক্রমশও গুরুত্বপূর্ণ স্বাদে ও ঘ্রাণে অনন্য এই মাছটি। ভারতে দূর্গাপূজায় মিলবে না বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ। এমন খবরে হাহাকার ওপার বাংলায়। মাথায় হাত ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের। ঠিক এমন প্রেক্ষাপটেই সুসংবাদ দিয়েছে বাংলাদেশ। অবসান ঘটেছে সব জল্পনার। পদ্মার রূপালি ইলিশ অবশেষে ঠাঁই করে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির পাতে।

ইলিশহীন দূর্গাপূজা উৎসব ভাবনায় ওপার বাংলার সব হতাশা-বেদনা হয়েছে দূরীভূত। দুধের স্বাদও মেটাতে হবে না ঘোলে! শেষ পর্যন্ত ঠিকই ইলিশ যাচ্ছে ভারতে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নতুন আরও একটি চমক তৈরি করলেন। এর মাধ্যমে ইলিশ কূটনীতির অধ্যায় যবনিকাপাতের শঙ্কাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে গ্রহণ করলেন ইতিবাচক পদক্ষেপ। ঝানু কূটনীতির দূরদর্শীতায় ঢাকা-দিল্লির চলমান শীতল সম্পর্কের বরফ কিছুটা হলেও গলার মধ্যে দিয়ে অস্বস্তির কাঁটা দূর করে স্বস্তির দিকে মোড় দিয়েছেন।

সম্প্রতি ভারতের ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে এক চিঠিতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিতে অনুরোধ জানায়। সরকার এই অনুরোধে সাড়া দিয়ে দেশটিতে ইলিশ রপ্তানির নির্দেশনা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস প্রকারান্তরে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে।

ভরা মৌসুমে আকাশছোঁয়া দামের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনীতিতেও বর্তমানে হট টপিক ইলিশ। যদিও দু’ দেশের ঐতিহ্যগত সম্পর্কে সব সময় বড় অন্তরায় হয়ে ঠেকেছে তিস্তার পানি। বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত করায় ২০১২ সালে ভারতে রপ্তানি বন্ধও করা হয় মাছটি। আজও তিস্তা ইস্যুর সুরাহা না হলেও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ভারতে ইলিশ পাঠানো আবারও শুরু করে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। পূজা-পার্বণে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন ইলিশ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উপহারের কূটনীতিতে না হেঁটে ইলিশ পাঠানো বন্ধের ঘোষণা দেয়। যদিও সরকার ভারতে ইলিশ না পাঠানোর কারণ হিসেবে বেশি ধরা না পড়া, খারাপ আবহাওয়া এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের সময় ৮৮৫ কেজি ইলিশ জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

ইলিশকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তুলতেই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইলিশ রপ্তানির বন্ধের কথা বলে আসছিলেন। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘অনেক মাছ এখনো বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছে। এবার আমরা ইলিশকে সীমান্ত পার হতে দেব না।’ তিনি বিগত সরকারের ‘ইলিশ কূটনীতির’ প্রসঙ্গটি টেনে আরও বলেছিলেন, ‘আগের সরকার দুর্গাপূজার সময় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিত। তারা এটাকে উপহার বলত। এইবার আমি মনে করি না, আমাদের উপহার দেয়ার দরকার আছে। কারণ, ভারতে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানির অনুমতি দিলে আমাদের লোকজন মাছ খেতে পারবে না।’ পরে তিনি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এবারের দুর্গোৎসবে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্য নাগরিকরা যেন ইলিশ খেতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা হবে। ভারতের চেয়ে দেশের জনগণকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।’

এখনও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘ভারতে ইলিশ রপ্তানির যে অনুমতি হয়েছে, সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের না। এখনও ইলিশ যায়নি, মাত্র সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি এখনও আমার আগের সিদ্ধান্তেই আছি যে আগে দেশের মানুষকে ইলিশ খাওয়াতে হবে, পরে রপ্তানি। এ জন্য বাজারে ইলিশের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। তবে রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর ইলিশের দাম বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।’ তিনি বলেন, ‘পূজার সঙ্গে ইলিশ রপ্তানির কোনও সম্পর্ক নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কলকাতার ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করেছে।’

ড.ইউনূসের কূটনৈতিক কৌশলকে ইতিবাচক বলছেন বিশ্লেষকরা
বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে স্বীকৃত ইলিশ। রূপালী মাছটি বাংলাদেশের একান্তই নিজস্ব। বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ। দেশের জিডিপিতে এটি প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশের জেলেরা বছরে ৬ লাখ টন ইলিশ ধরেন এবং এই মাছের বেশির ভাগটাই আসে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বাঙালি সংস্কৃতি এবং রন্ধনপ্রণালিতে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ইলিশ মাছ। সূক্ষ্ম স্বাদ এবং নানা ব্যবহারের জন্য এই মাছ প্রশংসিত। তাই ইলিশের অভাব হলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় অঞ্চলের মানুষের জন্যই এটি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পতিত সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো ছিল। তাই শেখ হাসিনার পতনের পর সম্পর্ক শীতল হয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই দেশেরই সম্পর্ক ভালো রাখা দরকার। তবে অবশ্যই সেটি পারস্পরিক সমান সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই হতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ড. ইউনূসের যোগ দেওয়ার আগে এ বিষয়টি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। ভারত থেকে এরই মধ্যে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এসেছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকা অনেক স্বস্তির।’

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকা দুই দেশের জন্যই দরকার বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভালো হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ গত দেড় মাস ধরে এই সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে।’

ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে বাহবা পেয়েছি জানিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের ইলিশও না। রপ্তানির বিপক্ষে যারা বলে তারা ইমোশনাল।’ ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘ইলিশ রপ্তানিতে বাণিজ্যিক সুবিধা আছে। ফরেন কারেন্সি আসে। রপ্তানি না করলে চোরাচালান হয়। রপ্তানিতেও গ্রেটার ইন্টারেস্ট আছে।’

কালের আলো/এমএএএমকে