শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট কে এই দিশানায়েকে?

প্রকাশিতঃ 10:40 am | September 23, 2024

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, কালের আলো:

শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় দফায় গড়ানো ভোট গণনায় নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে হারিয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহেকে। তবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাজিথ প্রেমাদাসা। গণবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর দুই বছরের বেশি সময় পর দেশটির ক্ষমতায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এলো।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বকে একরকম চমকে দিলেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। ৫৫ বছর বয়সী শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক জোটটি এর আগে বিরোধী দলও ছিল না। দেশটির ২২৫ সদস্যের সংসদে তাদের আসন ছিল মাত্র তিনটি। অথচ সেই জোট থেকে প্রেসিডেন্ট বেছে নিল দ্বীপরাষ্ট্রটির জনগন।

দিশানায়েকের জোটটির নাম ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। এই দলকে ভারতের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ঘনিষ্ঠ বলেই দেখা হয়। অন্যদিকে বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক মার্কবাদী।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরের অনুরাধাপুরা জেলার থামবুত্তেগামা গ্রামে জন্ম দিশানায়েকের। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত এক পরিবারের সন্তান তিনি। কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন দিশানায়েকে।

ছাত্রজীবন থেকে জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। ২০০৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশটির কৃষি, প্রাণিসম্পদ, ভূমি ও সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

২০১৪ সালে জেভিপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন দিশানায়েকে। তারপর থেকে তিনি দলের ভাবমূর্তিকে সহিংসতা থেকে আলাদা করায় ব্রতী হন। সে বছর মে মাসে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি দলের অতীত সহিংস পথকে ভুল বলে উল্লেখ করেন। এতে তার ও তার দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটির সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দিশানায়েকে।

দিশানায়েকের দল জেভিপির বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কাং সহিংস রাজনীতিতে জড়ানোর ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭১ এবং তারপর ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে এই পার্টি মার্ক্সবাদে অনুপ্রাণিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। এতে গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ ও গণহত্যার শিকার হন জেভিপির নেতাকর্মীরা। দলসংশ্লিষ্ট কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়। এর মধ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরাসহ বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাও ছিলেন।

তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টায় সহিংসতাকে ভুল উল্লেখ করে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।

জেভিপি এর আগে কখনো ক্ষমতার কাছাকাছিও ছিল না। দুবার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে।

তবে ২০২২ সালে প্রেক্ষাপটই বদলে যায়। সরকার পক্ষের দুর্নীতি ও ভুলনীতির কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, দেখা দেয় চরম মুদ্রাস্ফীতি। এতে গণবিক্ষোভের মুখে পড়েন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে সরকার। ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে রক্ষা পেতে ভাইসহ দেশ ছেড়ে পালান গোতাবায়া।

সেই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে জেভিপি। রাজাপক্ষে ভাইদের পদত্যাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষমতার শূন্যতায় দিশানায়েকে এবং জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেভিপির জিরো টলারেন্স নীতি শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের আকৃষ্ট করে। দ্রুতই প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় দলটি। দলের সঙ্গে দিশানায়েকের জনপ্রিয়তাও হু হু করে বেড়ে যায়। দিশানায়েকে ও তার দলের সবচেয়ে কার্যকর স্লোগান – দুর্নীতি মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি।

এদিকে জেভিপি দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কায় ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকেও তারা দেশের ওপর ভারতের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে বিবেচনা করে। ২০০০-এর দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দার আমলে তামিল আন্দোলন যখন থামিয়ে দেওয়া হয়, জেভিপি সরকারকে সমর্থন করেছিল।

এই দুটি বিষয়ও প্রভাব ফেলেছে দিশানায়েকের ভোটব্যাংক বৃদ্ধিতে।

দিশানায়েকে বলেছেন যে তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে রাজাপক্ষে সরকারের যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য তিনি অনুশোচনা করেন না।

প্রসঙ্গত, শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন দেশটির ১ কোটি ৭০ লাখ ভোটার। এবারের নির্বাচনে যেকোনো প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না, এমন ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা।

ভোটাভুটির পর দেখা যায়, অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে পেয়েছেন ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার ৯১৫ ভোট, যা মোট ভোটের শতকরা ৪২ দশমিক ৩১ ভাগ। সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন ৪৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫ ভোট, শতকরায় ৩২ দশমিক ৭৬ ভাগ। অন্যদিকে রনিল বিক্রমাসিংহে পেয়েছেন ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৬৭ ভোট (শতকরা ১৭ দশমিক ২৭ ভাগ)।

কেউই ৫০ ভাগ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ভোট গণনা হয়। সেখানে বিজয়ী হন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ