অনেক প্রশ্নের খোলাসা করলেন বিজিবি ডিজি, জানালেন কৌশলে আন্দোলনের পক্ষে কাজ করার কথা

প্রকাশিতঃ 10:39 pm | October 03, 2024

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

কখনও কথাগুলো তিনি বলেননি। অনেকবার এসব প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। তবুও নিজে চুপ আর নমনীয় থেকেছেন। কিন্তু এবার সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনকেই যেন ভালোবেসেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই ইতিবাচক থেকে কাজ করেছেন তিনি। অনেক দিন পর বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিজিবি সদর দপ্তরে কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুরো বিষয়ের খোলাসা করেছেন।

সাফ সাফ জানালেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সরকার বিজিবিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তা না করে ছাত্র-জনতার পক্ষে বিজিবি কৌশলগতভাবে কাজ করেছে। বিজিবি মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে ইচ্ছে করেই ঝুঁকি কমাতে বিজিবি ভারী গোলা মোতায়েন করেনি। বিজিবিকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটি করিনি আমরা। সরকারি আদেশ মান্য করার পাশাপাশি অভ্যুত্থানে বিজিবি ছাত্রদের সহায়তা করেছে।’

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে বিজিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক বড় বড় জায়গা থেকে রিকোয়েস্ট করা হয়েছিল। অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষে কৌশলগতভাবে কাজ করেছে বিজিবি।’ শুধু তাই নয় বিজিবি ডিজি জানিয়েছেন আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বেশকিছু বিজিবির সদস্য আহত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিজিবির একজন সদস্য নিহত এবং ১০৩ জন সদস্য আহত হয়।’

সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অবৈধভাবে কীভাবে পালালেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নিয়ম-নীতির বাইরে সীমান্তে ভারতকে ছাড় না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে খোলামেলা কথা বলেন। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্গাপূজায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। সাবোটাজ হতে পারে।’

অবৈধভাবে কীভাবে পালালেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘জানে না’ বিজিবি
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী ২২ অ্যাকটিভিস্টকে গ্রেফতার করেছে বিজিবি। কিন্তু এর বাইরেও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী পালিয়েছেন। তারা কীভাবে কোন সীমান্ত দিয়ে দেশ থেকে পালালেন তা জানে না বিজিবি। বিজিবি’র ডিজি প্রশ্ন রাখেন, এর দায় শুধু বিজিবির কেন? আর অবশ্যই তদন্ত হবে, তদন্ত হচ্ছে। কোন বিওপি’র আওতাভুক্ত সীমান্ত এলাকা দিয়ে তারা পালিয়েছেন তা তদন্ত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ৬ আগস্ট থেকে টেলিভিশনে যে স্ক্রল দেখেছেন–সীমান্ত পথে পালানো রোধে বিজিবিকে সহায়তা করুন, এই কাজে কেউ বিজিবিকে নির্দেশনা দেয়নি, নিজ উদ্যোগে করেছি। তখন থেকে আমরা চেষ্টা করছি। তথ্য দেওয়ার যেসব সংস্থা আছে তারাও যদি তথ্য দেয় তাহলে কাজটা সহজ হয়। সবাই কি পালিয়ে গেছে? আমার মনে হয় না। জনবহুল এই দেশে কেউ কেউ আত্মগোপনে আছেন। মাদক ব্যবসায়ী বদিকে ধরার জন্য বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি। শোনা গেলো তিনি ট্রলারে করে মিয়ানমারে গেছেন। পরে কিন্তু গ্রেফতার হলেন সীতাকুণ্ড থেকে। এরকম একদিকে যাওয়ার আওয়াজ দিয়ে অন্যদিক থেকে পালানোর চেষ্টা করছে অনেকে, যুক্ত করেন তিনি। সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিজিবির সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তা বলেন, আপনাদের কাছেও তথ্য থাকে। বিজিবিকে জানান, আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমরা পালানো রোধে বদ্ধপরিকর।

নিয়ম-নীতির বাইরে সীমান্তে ভারতকে ছাড় দেবো না
সীমান্ত রক্ষায় বিজিবি বদ্ধপরিকর বলে জানান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, বিএসএফের চেয়ে বিজিবি কোনও অংশে কম নয়। সীমান্তে পিঠ দেখাবে না বিজিবি। বিজিবির পক্ষ থেকে আশ্বাস-নিশ্চিত করছি, নিয়ম-নীতির বাইরে আমরা বিএসএফ বা ভারতকে ছাড় দেবো না।’

সংবাদ সম্মেলনে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার বদলের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়েও জানতে চাওয়া হয় ডিজির কাছে। এক সাংবাদিকের প্রশ্নে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘আমি সীমান্ত ও বিজিবির প্রেক্ষাপট থেকে বলতে পারি, সীমান্তে যারা মাইনরিটি আছেন, তারা চলে যেতে পারেন, এ ধরনের অপপ্রচার অতিরঞ্জিত প্রচার করা হচ্ছিল। সে সময় বিএসএফ তাদের ক্যাম্পগুলোতে জনবল বাড়িয়েছে। তাদের অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের (ভারতের) সেনাবাহিনী আসার কথা নয়, কিন্তু সে সময় আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ির মুভমেন্ট দেখেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘হয়তো তারা শঙ্কায় ছিল যে বড় একটা অংশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায় কি না। আমরা এটার লিখিত ও মৌখিক প্রতিবাদ করেছি। পরে ডিজি পর্যায়ে বিএসএফের সঙ্গে যে বৈঠক হবে, সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। তবে তারা (বিএসএফ) জানিয়েছে, তাদের সেনাবাহিনী সেখানে ছিল না। কিন্তু তারা নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, নানাভাবে এদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে।’

আমাদের দেশের কিছু অপরাধী চক্র বিএসএফকে তথ্য দিচ্ছে দাবি করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা এমন কয়েকজনকে শনাক্ত করে এনটিএমসির মাধ্যমে পুলিশে সোপর্দ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন আমরা আর সীমান্তে পিঠ দেখাবো না। এর মধ্যে বিজিবি কর্তৃক বিএসএফ সদস্যও আটক হয়েছেন।’

বিজিবি সার্বিকভাবে বিষয়টি কীভাবে নিচ্ছে, জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, ‘বিএসএফ সদস্য একজন কৃষককে ধাওয়া করে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে ওই বিএসএফ সদস্য ভুল স্বীকার করেন, তাহলেও কিছু নিয়ম-নীতি আছে। আটক ব্যক্তি কোনও ধরনের ক্ষতি করবে না বলে যদি জানান, তাহলে বিওপি পর্যায়ে পতাকা বৈঠক করে তাকে ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে।’

তবে বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে কুলাউড়া সীমান্তে স্বর্ণা দাস, ঠাকুরগাঁও সীমান্তে জয়ন্ত মারা গিয়েছে, যারা সাবালকই নয়। তাহলে তাদের হত্যা করতে হবে কেন? তারা তো নিরস্ত্র ছিল। এ দুটি ঘটনার পরই ওই বিএসএফ সদস্য ঢুকে পড়লে আমরা আটক করি। আমরা বলেছি, বিওপি পর্যায়ের বৈঠকে আমরা ফেরত দেবো না। ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তাবেও আমরা বলেছি হবে না। পরে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক করে তাকে ফেরত দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘ওই বিএসএফ সদস্য লিখিত দিয়েছেন তিনি বাকি জীবনে আর এ ধরনের কাজ করবেন না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে পরদিন কিছু ভারতীয় পত্রিকায় লেখা হয় বাংলাদেশি কৃষক নিরস্ত্র অবস্থায় বিএসএফ সদস্যকে পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে। সেটা নিয়ে আমাদের দেশে কোনও খবর হয়নি। আমরাই প্রতিবাদ পাঠিয়েছি তাদের পত্রিকায়।’

মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা সীমান্তে পিঠ দেখাবো না। আগে এ ধরনের ঘটনায় নানা ক্লিয়ারেন্স নিয়ে কাজ করা লাগতো। এখন আমি সরাসরি কাজ করতে পারছি। তবে অফিসিয়াল পেশাদার একটা সম্পর্ক বিএসএফের সঙ্গে রাখতে হবে। সেটা রক্ষয় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সীমান্ত নিরাপত্তার স্বার্থে। তবে কোনও কিছুতে কম্প্রোমাইজ করে নিজেরা ছাড় দিয়ে সীমান্তে কিছু হবে না। কারণ বিএসএফের চেয়ে বিজিবি কোনও অংশে কম নয়।’

ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বিজিবির বেশকিছু সদস্য আহত হয়েছে
বাহিনীটির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘র‍্যাবে দুজন বিজিবি সদস্য ডেপুটেশনে ছিল তারা ছাত্র-আন্দোলনের নিহত হয়েছেন। বিজিবির মোট ১০৩ জন সদস্য আহত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১০৩ জন সদস্যের মধ্যে বেশকিছু সদস্য আহত হয়েছে পুলিশের গুলিতে। একই জায়গায় ডিউটি করাকালীন এমন ঘটনা ঘটে। তবে ভাগ্য ভালো ছিল এগুলো সব ছররা গুলি ছিল। বাকি সদস্য আহত যারা ছিলেন তারা খুব বেশি গুরতর আহত নয়। বেশিরভাগই সুস্থ হয়েছেন।’

পুলিশের মতো বিজিবির কোনো সদস্য পলাতক আছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিজিবির কোনো সদস্য পলাতক নেই। বিজিবির কোনো অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়নি। তবে আমাদের বেশকিছু গাড়ি পুড়ে গেছে।’ ডিজি বলেন, ‘বিজিবির জনবল প্রায় ৫৭ হাজার। পুরো বিজিবি সদস্যের ৬ শতাংশের কিছু বেশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মোতায়েন ছিল। কেন এতো কম মোতায়েন হয়েছে সেজন্য আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আগের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে কৈফিয়ত ও জবাবদিহি দিতে হয়েছে অসংখ্যবার।’

পুলিশ যে ভূমিকা পালন করছে সেই ভূমিকা বিজিবি অনেকক্ষেত্রে ইচ্ছে করে পালন করছে না সে বিষয়ে আমাকে দোষারোপ করা হয়েছে, যোগ করেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, বিজিবি যদিও এপিসির ওপরে অস্ত্র ছিল না। নরমালি কিন্তু এলএমপি বা মেশিনগান থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে আমরা অনেককে আমাদের বিজিবি হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের এখনো আটজন চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের যাবতীয় খরচ বিজিবি দিচ্ছে।

বিজিবি ডিজি আরও বলেন, পুলিশের চাইতে বিজিবির ১৫-২০ গুণ মারণাস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। বিজিবির কাছে লাইট মেশিনগান, মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড, রকেট বিধ্বংসী কয়েক প্রকারের অস্ত্র রয়েছে এগুলোর কোনোটাই ছাত্র আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়নি। কারণ কখনও সীমান্তে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর আওতাধীন থেকে প্রথম যুদ্ধ প্রতিরোধ বিজিবিকেই করতে হবে।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে