পোশাক শিল্পে অস্থিরতায় রপ্তানি বাজার হারানোর শঙ্কা

প্রকাশিতঃ 5:48 pm | October 04, 2024

মো: শামসুল আলম খান, কালের আলো:

পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি আরও আগেই মেনে নিয়েছে মালিকরা। স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয়েছিল স্বস্তি ফিরবে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতটিতে। কিন্তু কোনমতেই কাটছে না অস্থিরতা। পুনরায় অস্থির হয়ে উঠেছে গাজীপুর-সাভার-আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল। এতে করে রপ্তানি বাজার হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন উদ্যোক্তারা। আগস্টের শেষে শুরু হওয়া এ অস্থিরতার সঠিক কারণও কিনারা করা সম্ভব হয়নি। আন্দোলন-ভাঙচুর না থামায় দানা বাঁধছে সন্দেহ। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উদ্বেগ।

বুধবার (২ অক্টোবর) সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের টানা ৫২ ঘণ্টার অবরোধ প্রত‍্যাহার করেন শ্রমিকরা। ওইদিন দুপুর ১টার দিকে পুলিশের আশ্বাসে তারা সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। আবার, নতুন করে ১০টি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনর্বহাল এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। সকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগরা এলাকায় তারা বিক্ষোভ শুরু করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বিশৃঙ্খলা এড়াতে আশপাশের ১০টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

গত ১৫ দিন যাবত যেসব এলাকায় দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে, সেখানকার কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, শ্রমিকদের ক্ষোভের অনেক কারণের একটি হলো শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা, যেখানে বলা আছে, কোনও প্রতিষ্ঠানের কোনও শাখা বা বিভাগে বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা কোনও মজুরি পাইবেন না। বেতন বকেয়া রয়েছে, এমন অনেক কারখানায় শ্রমিকরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপেক্ষাকৃত ছোট কারখানার শ্রমিকরা নানা বৈষম্যের শিকার হয় এবং মালিকপক্ষের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ শ্রমিক ভুক্তভোগী হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরুষ শ্রমিক বনাম নারী শ্রমিকের দ্বন্দ্ব। কিছু কিছু কারখানায় পুরুষ শ্রমিকরা মনে করেন তারা বৈষম্যের শিকার। নানা অজুহাতে তাদের চাকরিচ্যুত করে নারীদের কাজে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধের দাবি জানান তারা।

জানা যায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে পোশাক শিল্পের বর্তমান সংকট নিরসনে করণীয় নিয়ে মতবিনিময় সভায় পোশাক মালিকরা বিশৃঙ্খলা ঠেকানো না গেলে কারখানা বন্ধের হুঁশিয়ারি দেন। তৈরি পোশাক মালিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানা চালু হওয়ায় বেশিরভাগ মালিক আপাতত খুশি হলেও অনেকের মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বাস্তবে সব কারখানায় নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব হবে না। আর সেটা সম্ভব না হলে শ্রমিকদের কীভাবে সামলানো হবে, তা আমাদের জানা নেই। এছাড়া অনেকেই এখনও কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। কারখানার ভেতরে হুটহাট অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

পোশাক শ্রমিক নেতা কাজী রুহুল আমিন বলেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার জামিনের ঘটনায় সারা দেশের শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, অতীতের সরকারগুলো যেমন মালিকদের পক্ষপাতিত্ব করেছে এ সরকারও প্রকারান্তরে তাই করছে। কেননা মাহমুদ গ্রুপ, বার্ডস গ্রুপ, এএমজেড গ্রুপসহ অনেক কারখানা বেতন পরিশোধ করেনি। ১৮ দফা চুক্তি করেও মালিকপক্ষ তা মানেনি। সেইসব মালিকদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। তারওপর গত শুক্রবার রাতে আশুলিয়ার মন্ডল নিটওয়্যার লিমিটেডের দুজন শ্রমিককে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। পরের দিন আন্দোলনের চাপে একজন নারী শ্রমিককে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরেকজনকে হুমকি দিয়ে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

শিল্প পুলিশ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুর জেলার প্রায় বেশির ভাগ কারখানার সামনে লেখা রয়েছে- শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ। মাসের ১ তারিখ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটি কারখানার সামনেই শত শত শ্রমিক চাকরির জন্য ভিড় করেন। তবে কর্তৃপক্ষ ফটকে ‘শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ’ লিখে রাখলেও গোপনে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছেন। পুরুষ শ্রমিকরা চাকরিতে যোগদান করার পর অযথা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেন- এমন অভিযোগে তারা পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছেন না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্পে আর্থিক কী পরিমাণ ক্ষতির শঙ্কা করছেন এ প্রশ্নে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ব্যবসা হলে তবেই শ্রমিককে বেতন দিতে পারবেন মালিকেরা। এভাবে অস্থিরতা বিরাজ করলে ব্যবসা কমবে এবং পুরো খাতটাই অস্থির হয়ে থাকবে। আরও নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেবে।

কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ