প্রাণঘাতী ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যু

প্রকাশিতঃ 9:27 am | November 03, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

প্রাণঘাতী ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পিক সিজনে মশা নিধনে কার্যকর ভূমিকা না থাকায় ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুও বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় গত কয়েক মাসে রোগী বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। শুধুমাত্র শুক্রবার (০১ নভেম্বর) সকাল ৮টা থেকে শনিবার (২ নভেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৯৬৬ জন। সচেতনতা এবং মশা নিধনের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকলে ডেঙ্গু ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এতো কিছুর পরেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গা ছাড়া ভাব যাচ্ছে না। তারা গতানুগতিক ধারায় কাজ করায় নাজুক হয়ে ওঠছে পরিস্থিতি।

  • একদিনে ১০ জনের মৃত্যু
  • চলতি বছর ৬৩ হাজার ১৬৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি
  • মশক নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেই
  • দুই মন্ত্রণালয়ের গা ছাড়া ভাব

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪২.৯৫ শতাংশ ঢাকা মহানগরে এবং ৫৭.৫ শতাংশ ঢাকার বাইরে। মৃতদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ঢাকায় এবং ৩০ শতাংশ ঢাকার বাইরে। চলতি বছর এপ্রিলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় দুই জনের। শনাক্ত হয় ৫০৪ জন। মে মাসে মৃত্যু হয় ১২ জন এবং শনাক্ত হয় ৬৪৪ জন। জুনে মৃত্যু হয় আট জনের এবং শনাক্ত ৭৯৮ জন। জুলাই মাসে মৃত্যু ১২ জনের এবং শনাক্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন। আগস্টে মারা যায় ২৭ জন, শনাক্ত হয় ৬ হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরের মারা যায় ৮০ জন। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এ এলাকায় ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

শনিবার (২ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘন্টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪ জন, উত্তর সিটিতে ১ জন, বরিশাল বিভাগে ৩ জন, খুলনা ও ময়মনসিংহ বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৯৬৬ জন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৬৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭২ এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৮০ জন, খুলনা বিভাগে ৮১ জন, রাজশাহী বিভাগে ২১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪০ জন, রংপুর বিভাগে ২ জন এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন ভর্তি হয়েছেন।

এদিকে, গত এক দিনে সারা দেশে ৭৯১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৭২৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৬৩ হাজার ১৬৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩১০ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।

জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ঢাকার গুলশান, মহাখালী, শেওড়াপাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দারা। এমন কি বাংলামটর, পল্টন, জুরাইন, পুরান ঢাকা, মগবাজার, গুলশান-১ ও ২, রামপুরা, কাওরান বাজার এলাকাতেও মশক নিধন কর্মীরা সক্রিয় নন।

ডিএনসিসির ঘোষণা অনুযায়ী, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল কেনার কার্যক্রমও বন্ধ। গত কয়েক মাসে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো জলাশয়ের ঝোপঝাড়ও পরিষ্কার করা হয়নি। এ সময় লার্ভি সাইডিং ও অ্যাডাল্টি সাইডিং করতেও মশক নিধন কর্মীদের কালেভদ্রে দেখা গেছে বলে জানান নগরবাসী। এছাড়া মশার ডিম পাড়ার মতো পাত্রগুলোও ধ্বংস করা হয়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, আগস্ট মাসের তুলনায় ঢাকার দুই সিটিতে চলতি মাসে এডিসের বংশবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। দুই সিটির ব্রুটো ইনডেক্সও (লার্ভা বা শূককীটের ঘনত্ব) আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবরে বেড়েছে; কিন্তু আসলে ঢাকা বা বাইরে এডিস মশার ঘনত্ব আসলে কত তা বোঝার উপায় নেই, কারণ কোনো জরিপ নেই। জুলাই ও আগস্ট মাসে আন্দোলনের সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়। এটি জনস্বাস্থ্যের জটিল বিষয়। এর সঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নগর ব্যবস্থাপনা, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয় জড়িত। এটি বুঝতে পারলে জরিপের মতো বিষয়কে পাশ কাটানো যেত না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, জমে থাকা এক চা-চামচ পানিতেও এডিস মশা জন্মাতে পারে। অন্যটি হচ্ছে যদি মশা ঘরে চলে আসে, তাহলে মশারি টানাতে হবে। তিন-চার দিনের মধ্যে পানি ফেলে দিলেই আর লার্ভা থেকে মশা হতে পরবে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর শরীরে আইজিজি অ্যান্টিবডি থেকে যায়, ফলে দ্বিতীয় বার ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হয়। আমার মতে, দ্বিতীয় বার ডেঙ্গু হওয়া রোগীকে হাসপাতালেই অবজারভেশনে রাখা প্রয়োজন। কারণে এদের মধ্যে মৃত্যু বেশি হয়। প্রাইমারি ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমাতে চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ খুব দরকার, বলে মনে করেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেই দিতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্ত হবে কিন্তু এই মুহূর্তে তারা ক্রিটিক্যাল রোগী না অথচ তারা ঝুঁকিপূর্ণ বয়সের, বা ঝুঁকিপূর্ণ রোগ আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ, অ্যাজমা, ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস হচ্ছে, তাদের জন্য সেকেন্ডারি হাসপাতাল করতে হবে। কারণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর এত চাপ থাকে যে, এ ধরনের ডেঙ্গু রোগীরা ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ডে যেতে যেতে মারা যায়।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যদি সরকারি রেটে ডেঙ্গু শনাক্তের ব্যবস্থা করা হতো, তা হলে রোগী শনা ক্ত আরও বেশি হতো ও রোগীরা সাবধান হয়ে যেত। এখন শনাক্ত হয় না। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, হাসপাতালে আনতে আনতে শেষ। এজন্য জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজে জোর দিতে হবে।

কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে