দোর্দণ্ড প্রতাপে যেভাবে হোয়াইট হাউজের মসনদে লড়াকু ট্রাম্প

প্রকাশিতঃ 11:33 pm | November 06, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

চার বছর পর ঠিকই দোর্দণ্ড প্রতাপে হোয়াইট হাউজে ফিরলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক ফলাফলে বিজয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান এই প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসকে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে বড় ব্যবধানে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউজের দখল করলেন সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। নিজের জয় ঘোষণা করে তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকা আমাদের অভূতপূর্ব ও শক্তিশালী একটি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এটি আমেরিকার সুবর্ণ যুগ। যা আমেরিকাকে আবারও মহান করে তোলার সুযোগ এনে দেবে।’ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটিতে নারীরা নয়, পুরুষরাই নেতৃত্বে আসেন বারবার এমন তত্ত্বও যেন আরও একবার প্রমাণিত হলো। ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়ে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার সময় ট্রাম্প সমর্থকদের উদ্দেশে এক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা নতুন রূপে ফিরে আসবো’। সম্ভবত তখন কেউ বিশ্বাস করেনি। সবাই ধরে নিয়েছিল মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্প যুগের অবসান হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে তাঁর সাবেক উপদেষ্টা ব্রায়ান লানজার মন্তব্য যথার্থই। তিনি বলেছিলেন-‘তিনি (ট্রাম্প) পড়ে গেলে দ্বিগুণ উদ্যমে উঠে দাঁড়ান। তার প্রত্যাবর্তনে কারও অবাক হওয়ার কিছু নেই’।

মঙ্গলবার (০৫ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত দেশটির ৪৭তম নির্বাচনে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে অটল ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই বেছে নিয়েছেন মার্কিন ভোটাররা। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচনী ফল অনুযায়ী, দেশটির নির্বাচনে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ২৭০টির প্রয়োজন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ সময় বুধবার পৌন ৪টার দিকেই এই ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে যান। দেশটির নির্বাচনে ফল নির্ধারণী ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্য খ্যাত জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, ফ্লোরিডা, মেইন, পেনসিলভানিয়ায় লাল শিবিরের জয়ে হোয়াইট হাউসের মসনদ নিশ্চিত হয় ট্রাম্পের।

এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভোট দিতে দেখা যায় ভোটারদের। ভোটের প্রাথমিক ফলাফল সামনে আসতে শুরু করলে ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তার দলের ইলেকটোরাল ভোটের পাল্লা। গত নির্বাচনে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি ট্রাম্প। ফলাফল, নির্বাচনে হার। কিন্তু এবার সেসব রাজ্যে দারুণভাবে ‘কামব্যাক’ করেছেন লড়াকু সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। জয় ছিনিয়ে এনেছেন বেশিরভাগ ব্যাটেলগ্রাউন্ডে।

ট্রাম্পের এই অভাবনীয় প্রত্যাবর্তন রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে। তিনি কেবল ধ্বংস থেকে পুনর্জন্মই নয়, বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ট্রাম্পের উপস্থিতি তার সমর্থকদের মাঝে নতুন করে উচ্ছ্বাসের সঞ্চার করেছিল। কনফারেন্সে ইলন মাস্কসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ট্রাম্পকে সমর্থন জানান। এতে তার নির্বাচনি প্রচারণায় অনুপ্রেরণা ছড়ায়। ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বিতর্কের পরও ট্রাম্প তার দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখেন। মূলত এসবই ভোটে তাঁর বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

রক্তাক্ত ট্রাম্পের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের দৃশ্যই আকৃষ্ট করে ভোটারদের
এবারের নির্বাচনে মূল লড়াইটা হওয়ার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। কিন্তু প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট শিবিরে জোর দাবি ওঠে, ৮১ বছর বয়সী জো বাইডেনকে সরিয়ে অন্য কাউকে প্রার্থী করা হোক। তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছিলেন একের পর এক অর্থদাতা। তবুও শেষপর্যন্ত লড়াইয়ে থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু গত ১৩ জুলাই নির্বাচনী সমাবেশে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর বদলে যায় সব হিসাব-নিকাশ। কপালজোরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ট্রাম্প আসন্ন নির্বাচনী ভূমিধস জয় পেতে চলেছেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন বিভিন্ন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।

এ অবস্থায় নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ডেমোক্র্যাটদের নাটকীয় কিছুই করতে হতো। এর মধ্যে তৃতীয়বারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাইডেন। আর তারপরেই নির্বাচনী দৌড় থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তার জায়গায় লড়াইয়ে নামেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। কমলাকে পেয়ে আগের চেয়ে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে ডেমোক্র্যাট শিবির। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠে নির্বাচনী লড়াই। ধারণা করা হয়েছিল, নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হবে দুই নেতার মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকটা হেসেখেলেই জয় ছিনিয়ে নেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প। প্রতিপক্ষের মুখের বুলি নয়, নির্বাচনী সভায় গুলির আঘাতে রক্তাক্ত ট্রাম্পের মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের দৃশ্যই ভোটারদের বেশি আকৃষ্ট করেছে, তা নির্বাচনের ফলাফলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা এডিসন রিসার্চ বলছে, ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০টিরও বেশি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে হোয়াইট হাউস পুনরুদ্ধার করেছেন; যা দেশটিতে চলমান মেরুকরণের রাজনীতিকে আরও গভীর করে তুলেছে। বুধবার স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৬ টার দিকে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণী দোদুল্যমান রাজ্য-খ্যাত উইসকনসিনের ফল প্রকাশের সাথে সাথেই ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। উইসকনসিনের ১০টি ইলেক্টোরাল ভোটের মাধ্যমে ম্যাজিক ফিগার ২৭০ পেরিয়ে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

অন্যদিকে, মার্কিন বার্তা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২৭৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলীয় কমালা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। তবে এখনও কয়েকটি রাজ্যে আংশিক ভোট গণনা বাকি রয়েছে।

ট্রাম্পকে বেছে নেওয়ার নেপথ্য কারণ
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির উত্তর আমেরিকা-বিষয়ক সম্পাদক সারাহ স্মিথ বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণার সময় আমি যত মানুষের সাথে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশই বলেছেন, তারা সুযোগ পেলে ট্রাম্পের ‘দুর্গন্ধযুক্ত কথাবার্তা’ বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পক্ষপাতী।’ কারণ হিসেবে তারা ট্রাম্পের একটি প্রশ্নের ওপর জোর দিচ্ছেন যেটি তিনি সব জায়গায় জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনারা কি দুই বছর আগের তুলনায় এখন ভালো আছেন?’

ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া বহু মানুষ বলেছেন, তারা মনে করেন ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তারা বর্তমানের চেয়ে ভালো ছিলেন। অর্থনৈতিক মন্দা বা মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বাইডেন প্রশাসন দায়ী বলে মনে করেন ভোটারদের একটা বড় অংশ। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে রেকর্ড মাত্রার অবৈধ অভিবাসন নিয়েও ভোটারদের একটা বড় অংশকে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে দেখা যায়। ট্রাম্প বা তার সমর্থকদের মতো এই ভোটারদের অনেকেই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের পক্ষপাতী ছিলেন।

এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান ভোটারদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে বলে মনে করেন সারাহ স্মিথ। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকাজুড়ে ডানপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে আমি হতাশা দেখতে পেয়েছি একটি বিষয়কে ঘিরে; সেটি হলো, তারা মনে করেন ইউক্রেনে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে তা যদি আমেরিকার ভেতরে খরচ করা হতো তাহলে তা আমেরিকার অর্থনীতিকে অনেক শক্তিশালী করতে পারতো। এই বিষয়টি মাথায় রেখে অনেকেই কমালা হ্যারিসকে ভোট দিতে পারেননি; যিনি চার বছর জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা মনে করেছেন, কমালা হ্যারিসকে ভোট দিলে ইউক্রেন-বিষয়ক নীতি অনেকটা এক রকমই থাকতো।’

কালের আলো/আরআই/এমকে