ছাত্র-আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই ‘ইতিবাচক’ বিজিবিকে নিয়ে অপপ্রচারে সতর্ক বার্তা  

প্রকাশিতঃ 7:55 pm | November 30, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

বহু প্রাণ ও স্বপ্নের মূল্যে মিলেছে নতুন এক বাংলাদেশ। ‘৩৬ জুলাই’ গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল দেশে বীর ছাত্র-জনতার রক্ত আর বুদ্ধিবৃত্তিক অভূতপূর্ব কৌশলে শেষতক পর্যদস্তু হয় তৎকালীন সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অবিশ্বাস্য রকমের বহুবর্ণিল পথরেখায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে বিজিবি এবং বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর ভূমিকা সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন ও মনগড়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।

বিজিবি বলছে, একটি চক্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বিজিবি এবং ডিজি বিজিবির নামে এই অপপ্রচারগুলোতে দাবি করা হচ্ছে যে, বিজিবি প্রধান ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এবং ভারতীয় নাগরিকদের পোশাক পরিয়ে মাঠে নামিয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার ষড়যন্ত্র এবং শিক্ষার্থীকে হত্যার মনগড়া তথ্যও ছড়ানো হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানেও বিজিবি’র দাবিকৃত বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে। প্রকৃত পক্ষেই ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে শুরু থেকেই ইতিবাচক থেকে কাজ করেছেন বিজিবি ও ডিজি বিজিবি। তৎকালীন সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে বিজিবিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু বিজিবি সেই দায়িত্ব পালন না করে কৌশলগতভাবে ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি ঝুঁকি কমাতে তাঁরা ভারী গোলাও মোতায়েন করেনি। ৫ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকার প্রবেশদ্বারে বিজিবি ছাত্র জনতাকে সমর্থন করেছে। বিজিবি মহাপরিচালকের আন্তরিকতায় ও চিকিৎসা শাখার সার্বিক তত্ত্বাবধানে গত ১৯ জুলাই শুরু থেকেই আহত ছাত্রদের পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে নিয়ে এসে মোবাইল অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বেশি আহত রোগীদের হাসপাতালের ভেতরে গোপনে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এমনকি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বেশকিছু বিজিবির সদস্য আহত হয়েছেন। পুরো আন্দোলনে নিহত হয়েছেন বিজিবির একজন সদস্য। আহত হয়েছেন ১০৩ জন সদস্য।

শনিবার (৩০ নভেম্বর) বিজিবির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্টে বলা হয়েছে, একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিজিবি ও ডিজি বিজিবি’র সুনাম নষ্টের জন্য এসব অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। অপপ্রচারে কান না দিয়ে সত্যের পক্ষে থাকুন। বিভ্রান্তি এড়াতে যাচাই-বাছাই করুন এবং প্রকৃত তথ্য সবার সামনে তুলে ধরুন। বিজিবি দেশের মানুষের পাশে থেকে দায়িত্ব পালন করেছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে।

ওই পোস্টে সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচারের জবাবে প্রকৃত সত্য হিসেবে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরেছে বিজিবি। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- ডিজি বিজিবির নির্দেশনায় আন্দোলনে ছাত্র জনতাকে হত্যার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। ভারতীয় নাগরিকদের বিজিবির পোশাক পরিয়ে আন্দোলন দমন করার তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ৫ আগস্ট বিজিবি ডিজি’র তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ১০ হাজার লোক মেরে ফেলা কিংবা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা ইত্যাদি বিষয়ে কোন ধরনের কথাই হয়নি। মূলত ৫ আগস্ট সকাল থেকে ঢাকার প্রবেশদ্বারে বিজিবি ছাত্র জনতাকে সমর্থন করেছে। বিজিবির যে সদস্য অপেশাদার আচরণ করেছে তার/তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিজিবি’র ভূমিকার আদ্যোপান্ত নিয়ে চলতি বছরের বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিজিবি সদর দপ্তরে কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। সেদিন তিনি বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে বিজিবিকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটি করিনি আমরা। সরকারি আদেশ মান্য করার পাশাপাশি অভ্যুত্থানে বিজিবি ছাত্রদের সহায়তা করেছে। ৫ আগস্ট ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে বিজিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক বড় বড় জায়গা থেকে রিকোয়েস্ট করা হয়েছিল। অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষে কৌশলগতভাবে কাজ করেছে বিজিবি।’ এসব কারণেই সম্ভবত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অনেকে বিজিবির পিলখানার গেটে মিষ্টি নিয়ে আসে এবং উল্লাস প্রকাশ করে, এমন তথ্যও ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে অনেকের মুখে মুখে।

আত্মপ্রচারের বিপরীতে বরাবরই অবস্থান বিজিবি মহাপরিচালকের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাঁর মেয়ে ও জামাই, ভাগ্নে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাধা দেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছেন, আন্দোলন তো হচ্ছিল অধিকারের জন্য। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সমর্থন করেছিলেন বলেই কীনা জুলাই মাসের শেষের দিকে ওপরের নির্দেশে যখন গণগ্রেপ্তার কার্যক্রম শুরু হয় তখনও সেই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেনি বিজিবি। ওই গণগ্রেপ্তারে অংশ না নিয়ে বিজিবি ডিজি তখন উল্টো যুক্তি দেখিয়েছেন, গ্রেপ্তার কার্যক্রমের জন্য বিজিবি প্রশিক্ষিত ও প্রস্তুত নয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের এক দফা-মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যখন নানা কায়দা-কানুনে বিজিবিকে কোন কোন পক্ষ কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছে তখনও তিনি চুপ আর নমনীয় থেকেছেন। কিন্তু ওই সংবাদ সম্মেলনে সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনকেই যেন ভালোবেসেছেন ডিজি বিজিবি। তাঁর একটি বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই ছাত্র আন্দোলনে বিজিবির ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায়। ওইদিন তিনি বলেন, ‘বিজিবির জনবল প্রায় ৫৭ হাজার। পুরো বিজিবি সদস্যের ৬ শতাংশের কিছু বেশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মোতায়েন ছিল। কেন এতো কম মোতায়েন হয়েছে সেজন্য আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আগের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে কৈফিয়ত ও জবাবদিহি দিতে হয়েছে অসংখ্যবার।’ পুলিশ যে ভূমিকা পালন করছে সেই ভূমিকা বিজিবি অনেকক্ষেত্রে ইচ্ছে করে পালন করছে না সে বিষয়ে আমাকে দোষারোপ করা হয়েছে, যোগ করেছিলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।

বিজিবি মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলনটিতে জানান, ‘পুলিশের চাইতে বিজিবির ১৫ থেকে ২০ গুণ মারণাস্ত্র বা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। বিজিবির কাছে লাইট মেশিনগান, মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড, রকেট বিধ্বংসী কয়েক প্রকারের অস্ত্র রয়েছে এগুলোর কোনোটাই ছাত্র আন্দোলনে ব্যবহার করা হয়নি। তাছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে আমরা অনেককে আমাদের বিজিবি হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের যাবতীয় খরচ বিজিবি বহন করেছে।’

সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি ডিজি গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনে একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার অফিসার গুলি করছেন। ওই ঘটনায় বিজিবি থেকে তাকে অপসারণ করা হয়েছে। তাকে শুধু ওএসডি করা হয়নি, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক শাস্তির জন্য সুপারিশ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তাকে বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যেন সেনাবাহিনীর অধীনে তার সাজা কার্যকর হয়। তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারি, তার সঙ্গে একজন মেজর ছিলেন। যদিও তিনি গুলি করেননি। তবে তিনি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছেন। তাকেও আমরা কিছুটা শাস্তির আওতায় নিয়ে আসছি।’

কালের আলো/এমএসএএকে