নতুন ৩৯৯ বিমানসেনা পেলো বিমান বাহিনী, বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও মানবিক গুণাবলীর চর্চার সদা যত্নবান হতে গুরুত্ব বিমান বাহিনী প্রধানের
প্রকাশিতঃ 11:10 pm | December 05, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
দীর্ঘ ৯ মাসের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গর্বিত বিমান সেনা। দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর কুচকাওয়াজে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার দৃপ্ত শপথ। বাদ্যের তালে তালে বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) মৌলভীবাজারের বাবিবা স্টেশন শমশেরনগরের রিক্রুটস্ ট্রেনিং স্কুলে (আরটিএস) সমাপনী কুচকাওয়াজের এগিয়ে চলে নবীন অকুতোভয় ৩৯৯ বিমানসেনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৫২তম নব বিমানসেনা দলের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পরিদর্শন এবং আকর্ষণীয় মার্চ পাস্ট-এর অভিবাদন গ্রহণ করেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। অনিন্দ্য সুন্দর ও স্মরণীয় এই দিনটিতে নতুন বিমানসেনাদের সম্ভাবনাময় নতুন জীবনে পদার্পণে অভিনন্দন জানান। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও দৃঢ় মনোবদলের বদৌলতে একদিন তাঁরা দক্ষ বিমানসেনায় পরিণত হবে। নবযাত্রার এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিমান বাহিনী প্রধান পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও মানবিক গুণাবলীর চর্চার সদা যত্নবান হতে গুরুত্বারোপ করেন।
- জাতির সূর্য সন্তান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
- কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের কারণেই সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত
- একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী ও গৌরবোজ্জ্বল বিমান বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
- বিমান বাহিনীতে প্রথমবারের মতো অনারারি কমিশন প্রবর্তন
দেশের আকাশ মুক্ত রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করার কথা জানান তিনি। বলেন, ‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত’ এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কাজ করলেও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দেশের আকাশসীমার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার অভিযান, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, সেনা ও নৌবাহিনী এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশ গঠন ও আর্তমানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরসমূহের সকল ফ্লাইটে নির্বিঘ্নে উঠা-নামাসহ নিরাপত্তা পরিবেশ ও সার্বিক কার্যক্রম স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বদলে গেছে দেশের প্রতিটি বিমানবন্দরের সেবা কার্যক্রমের দৃশ্যপট।’
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান কৃতি রিক্রুটদের মাঝে ট্রফি বিতরণ করেন। এই কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে মোট ৩৯৯ জন রিক্রুট বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ৩৭৮ জন পুরুষ এবং ২১ জন নারী। এসি-২ মো. মিজানুর রহমান ও এসি-২ মো. সুমন মিয়া শিক্ষা ও জেনারেল সার্ভিস ট্রেনিং এ সেরা রিক্রুট বিবেচিত হন। এসি-২ মেহেদী হাসান শুভ সার্বিক বিষয়ে কৃতিত্বের জন্য শ্রেষ্ঠ রিক্রুট বিবেচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এর আগে বিমান বাহিনী প্রধান প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌছালে বিমান বাহিনী ঘাঁটি কুর্মিটোলা এর এয়ার অধিনায়ক এয়ার কমডোর মোঃ মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক, বাবিবা স্টেশন শমশেরনগর এর স্টেশন কমান্ডার এয়ার কমডোর মোহাম্মদ মুশতাকুর রহমান ও রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুলের অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোঃ খায়রুল বাসার তাকে স্বাগত জানান।
জাতির সূর্য সন্তান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বক্তব্যের শুরুতেই বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেন জাতির সূর্য সন্তান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা দেশ মাতৃকার জন্য অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দিয়ে গেছেন লাল-সবুজের পতাকা ও একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। আমি আরও স্মরণ করছি কিলো ফ্লাইটের অকুতোভয় সদস্যদের, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় বিমান বাহিনী। আমি বিশেষভাবে স্মরণ করছি, গত জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্য দূরীকরণ ও সর্বস্তরে সাম্য ফিরিয়ে আনতে প্রাণ হারানো সকল শহীদ ছাত্র ও অন্যান্য সাধারণ ব্যক্তিবর্গকে। আমি আন্দোলনে নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের সকলের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।’
বিমান বাহিনীর রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুল (আরটিএস) একটি আদর্শ ও সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, ‘এখানে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রিক্রুটসরা খেলাধূলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, যা তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা আরও গভীরভাবে গেঁথে দেয়। নবীনদের আদর্শবাদী, দেশপ্রেমিক ও যোগ্য বিমান সেনা হিসেবে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আজকের মনোজ্ঞ পরিবেশে, সুন্দর আবহাওয়াতে তোমাদের প্যারেড আমাদের মুগ্ধ করেছে। তোমাদের প্যারেডের মান অত্যন্ত উন্নত ও দর্শনীয়। এজন্য তোমাদের আবারও অভিনন্দন জানাই।’
কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের কারণেই সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত
‘বিমান বাহিনীতে যোগদান করে দীর্ঘ ৯ মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে আজ তোমরা পদার্পণ করতে যাচ্ছো সম্ভাবনাময় এক নতুন জীবনে। নি:সন্দেহে এই দিনটি তোমাদের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে’-বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, ‘আজ থেকে তোমরা ‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত’ এই দৃপ্ত শপথে বলীয়ান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গর্বিত একজন বিমান সৈনিক। তোমাদের কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের কারণে আজ তোমরা সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছো। তোমাদের কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও দৃঢ় মনোবদলের বদৌলতে একদিন তোমরা দক্ষ বিমান সেনায় পরিণত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুল থেকে তোমরা যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছো তা যথাযথ অনুশীলন ও প্রয়োগের জন্য সদা সচেষ্ট থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখবে বলে আমি আশাবাদী।’
সমন্বিত প্রচেষ্টায় বিমান বাহিনী আরও আধুনিক হবে
এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে বিমান বাহিনীর প্রতিটি ভালো কাজের জন্য যেমন রয়েছে প্রশংসা ও পুরস্কার তেমনি মন্দ কাজের জন্য রয়েছে পুরস্কার ও শাস্তি। সহজলভ্য তথ্য প্রযুক্তি ও আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের বিষয়ে তোমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। নীতি বিবর্জিত সকল কর্মকাণ্ড ও বিশেষ করে মাদকদ্রব্য ব্যবহার হতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে। পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ও মানবিক গুণাবলীর চর্চার সদা যত্নবান থাকবে। নিজের পাশাপাশি মাতা-পিতার প্রতি যত্নশীল হবে। আজ থেকে শুরু হলো তোমাদের নবযাত্রা। তোমাদের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় বিমান বাহিনী আরও আধুনিক হবে এবং বিমান বাহিনীর সুনাম ও গৌরব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এটিই আমার বিশ্বাস।’
একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী ও গৌরবোজ্জ্বল বিমান বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে সীমিত সক্ষমতা ও জনবল এবং তিনটি জরাজীর্ণ বিমান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিলো ফ্লাইট। কিলো ফ্লাইট বর্তমানে একটি স্বনির্ভর, শক্তিশালী ও গৌরবোজ্জ্বল বিমান বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে মনে করেন বিমান বাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, ‘বিমান বাহিনীর আকাশসীমা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেকোন সময়ের চেয়ে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি অত্যাধুনিক, শক্তিশালী ও পেশাদার বিমান বাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের আধুনিক যুদ্ধ বিমান, সুপরিসর পরিবহন বিমান, সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন আর্মড হেলিকপ্টার, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা র্যাডার, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও যুগোপযোগী সামরিক সরঞ্জাম। বিমান বাহিনীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রশিক্ষণের উৎকর্ষ আনয়নের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক কমব্যাট ট্রেইনার, জেট ট্রেইনার, হেলিকপ্টার ট্রেইনার, বেসিক ট্রেইনারসহ বিভিন্ন ধরনের সিমুলেটর। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটি দক্ষ জনশক্তির যোগান দিতে নির্মাণ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এয়ারম্যান ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (এটিআই)।
অত্যাধুনিক এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আধুনিক ও অধিক সংখ্যক বিমানসেনাকে শুধু প্রশিক্ষণ প্রদান নয়, প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে জ্ঞান নির্ভর বিমান সেনা তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী নিজস্ব জনবল, প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা ব্যবহার করে এফসেভেন যুদ্ধ বিমান আমরা নিজেরাই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদস্যগণ তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমবারের মতো বেসিক ট্রেইনার বিমান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উদ্ভাবন ও কারিগরি সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। ভবিষ্যতে বিমান বাহিনী স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি একটি কার্যকর, দক্ষ ও আধুনিক বাহিনী হিসেবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ অবদান রাখতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি প্রযুক্তিনির্ভর, পেশাদার, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল বাহিনী। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অপারেশনাল কার্যক্রম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে।’
বিমান বাহিনীতে প্রথমবারের মতো অনারারি কমিশন প্রবর্তন
আনন্দের সঙ্গে বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, ‘মহান বিজয় দিবসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে অনারারি কমিশন প্রবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। যা বিমান সেনাদের পেশাদারিত্বকে সমৃদ্ধশালী করতে উৎসাহিত প্রদান করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
কালের আলো/এমএএএমকে