ফাঁকা বুলি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ

প্রকাশিতঃ 9:57 am | December 12, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ-এই প্রচার দীর্ঘদিন করেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের প্রায় সব মহল থেকেই বারবার বলা হতো এই কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশের মানুষের ভোগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। এ কারণে আমদানিনির্ভর পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে বিশ্ববাজার থেকে এক কোটি ১৩ লাখ ৫১ হাজার টন খাদ্য পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক পরিসংখ্যান বর্ষপঞ্জি-২০২৩-এ এসব তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।

এর বাইরে ডাল, ভুট্টা, গম থেকে শুরু করে গুঁড়া দুধের মতো মৌলিক খাবারের বড় অংশ বাংলাদেশ আমদানি করে। দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠা গম আমদানি করতে হয় প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় বছরখানেক আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। খাদ্যশস্য পরিস্থিতি শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শুধু চাল ও গমের হিসাব দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে দেশে চাল-গম আমদানির যে তথ্য এক যুগ ধরে প্রতিবেদনটি থেকে পাওয়া যায়, তাতে অন্তত কোনোভাবেই বলা যায় না, বাংলাদেশ চাল-গমে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কারণ, প্রতিবছরই বাংলাদেশ কমবেশি চাল-গম আমদানি করেছে। ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এটি ছিল বিগত সরকারের একটি ফাঁকা বুলি।

জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও অনেক কৃষি পণ্যই আমদানি করতে হয়। এতে একদিকে যেমন আমদানি বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে বৈশ্বিক সংকটের কারণে মাঝে মাঝেই আমদানি বিড়ম্বনায় পড়তে হয। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আমদানি হয় চীন থেকে, এরপরেই রয়েছে ভারত। দেশটি থেকে যেসব খাদ্যপণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্যতেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। যার ৯৫ শতাংশই আসে ভারত থেকে। সেজন্য ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে। যদিও, সম্প্রতি পাকিস্তান, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমদানি করা শীর্ষ দশটি পণ্যের মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত চিনি, পাম তেল, সয়াবিন তেল, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, আদা, মরিচ, গম, চাল, মসুর ডাল এবং পেঁয়াজ। এছাড়া রসুন, চা, তেলবীজ এবং হলুদ রয়েছে শীর্ষ খাদ্য সামগ্রী আমদানির মধ্যে রয়েছে।

আমদানিকৃত এসব পণ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো-পেঁয়াজ ও আলু। যদিও দুটি পণ্যই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে আলুর বাৎসরিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন ১০৪ লাখ মেট্রিক টন। পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ মেট্রিক টন, উৎপাদন ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঘাটতি না থাকলেও প্রতি বছরই পেঁয়াজ-আলু আমদানি করা হয়। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ শুধু চাল আমদানি করেছে ৮৫ কোটি ৯ লাখ ডলার। গম ১৮২ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। আমদানির তালিকায় আছে গুঁড়া দুধ, মসলা, ডালের মতো খাদ্যপণ্য।

জানা যায়, বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানির তথ্য নিয়ে গত সরকারের সময়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে খুব একটা আলোচনা ছিল না। বরং কোন পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ কোন অবস্থানে আছে, স্বাধীনতার পর থেকে দেশে কী পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, সেই ‘সফলতার’ ঢোল বাজাতেই তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন । বিশ্ববাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনা কমাতে অনেক আগেই উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। দরকার ছিল দেশে এসব খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া। কেননা, কথার মালায় বাস্তবতাকে ঢেকে দেওয়া যায় না। কিন্তু গত ১৫ বছরে এই কাজটিই করেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটা সরকার।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রাশিদুল ইসলাম একটি গণমাধ্যমকে বলেন, দেশে ১০০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়, চাহিদা রয়েছে ৬০ লাখ মেট্রিক টন। তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলু আমদানি করা হয়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও কেনো আমদানি করছে, এর কারণ খুঁজে বের করত হবে।

তিনি বলেন, গরু, মুরগী ও মাছের খাদ্য হিসেবে ভুট্টা ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ভুট্টা চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় আলুর জমি কমছে। কৃষকরা মাঝে মাঝে আলুর পরিবর্তে ভুট্টা চাষ করেন। আবার কোনো বছর ভুট্টা থেকে আলুর চাষ বেশি করেন। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে আলুর বাজারে।

অধ্যাপক ড. মো. রাশিদুল ইসলাম আরও বলেন, সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতার কারণে আলু আমদানি করতে হয়। মৌসুমে উৎপাদিত আলু সারাবছর চাহিদা মেটানোর জন্য যেভাবে সংরক্ষণ করা দরকার, তা হয় না। এছাড়া পর্যাপ্ত সংরক্ষাণাগারও নেই। অনেক আলু চাষী কোল্ডস্টোরেজ ফাঁকা পান না। সেখানেও সিন্ডিকেট রয়েছে। তাই বাজারে পর্যাপ্ত আলু সরবরাহের জন্য কোল্ডস্টোরেজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া অধিক লাভের জন্য অনেকে আলুবীজের ব্যবসায়ের দিকে ধাবিত হয়েছেন, এতে বাজারে আলু সরবরাহের পরিমাণ কমেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসাইন সিদ্দিকী একটি গণমাধ্যমকে বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরকারি পরিসংখ্যানে ভুল আছে। এটি বুঝা যায়, রাষ্ট্রের চাহিদা, যোগান ও আমদানির চিত্র দেখে। এজন্য অনেক কৃষিপণ্য উদ্বৃত দেখালেও আমদানি করতে হয়। নতুবা সরকারই ভক্ষক। তিনি বলেন, আমদানি যেহেতু করতে হয়, তাই যেখান থেকে আমদানি করলে ব্যয় কম হয়, জনগণ উপকৃত হয়, সেখান থেকে আমদানি করা দরকার। আমদানির ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির প্রভাব রয়েছে। তবে জনগণের স্বার্থ অবশ্যই দেখতে হবে।

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে